সরকারপন্থী? ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস। এপি
বিমল জালান কমিটির সুপারিশ মেনে ভারত সরকারকে ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা হস্তান্তর করার যে সিদ্ধান্ত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া সম্প্রতি গ্রহণ করেছে তাই নিয়ে নানা রকম মত বাজারে শোনা যাচ্ছে। কেউ বলছেন, সরকার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হাত মুচড়ে এই টাকা আদায় করছে, যা অত্যন্ত অন্যায্য। কেউ বলছেন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মালিক যে হেতু ভারত সরকার, তাই তার সম্পদের ওপর সরকারের পূর্ণ অধিকার আছে। বিষয়টাকে ভাল করে বোঝা দরকার। বিশেষত এই কারণে যে, টাকা হস্তান্তরের ব্যাপারটা আজ না হোক কাল সাধারণ ভারতবাসীর অর্থনৈতিক ভাগ্যকেও প্রভাবিত করবে।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯৩৪-এর ৪৭ নম্বর ধারা বলছে, কোনও আর্থিক বর্ষে সব খরচ-খরচা এবং ভবিষ্যতের সমস্ত সম্ভাব্য ঝুঁকির জন্য অর্থসংস্থান করার পর রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আয়ের যে অংশটা উদ্বৃত্ত থাকবে সেটা রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক কেন্দ্রীয় সরকারকে হস্তান্তর করবে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারকে উদ্বৃত্ত আয় হস্তান্তর করা রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে নতুন কিছু নয়, নিয়মবহির্ভূতও নয়। নতুন ব্যাপারটা হল, এই বিপুল পরিমাণে উদ্বৃত্ত আয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক আগে কখনও সরকারকে হস্তান্তর করেনি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮, এই দশ বছরে বার্ষিক হস্তান্তরের গড় পরিমাণ ৩৭,২৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবার ২০০৯ থেকে ২০১৩, এই পাঁচ বছরে গড় হস্তান্তর ছিল বছরে ২১,৫৫৯ কোটি টাকা। কিন্তু তার পরবর্তী পাঁচ বছরে, অর্থাৎ ২০১৪ থেকে ২০১৮ অবধি, বার্ষিক গড় হস্তান্তর বেড়ে হয়েছে ৫৩,০২২ কোটি টাকা। স্পষ্টতই, বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে হস্তান্তর উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। কিন্তু, ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকার মতো এত বড় অঙ্কের বার্ষিক হস্তান্তর আগে কখনও ঘটেনি। এই বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত আয় কোথা থেকে আসছে? তা হলে কি এ বছর রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আয় খুব বেড়ে গিয়েছে? না কি, তাদের খরচ বা ভবিষ্যৎ ঝুঁকির জন্য অর্থসংস্থানের প্রয়োজন হঠাৎ কমে গিয়েছে?
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আয়ের উৎস মূলত তিনটি। এক, তাদের ভাণ্ডারে গচ্ছিত ভারত সরকারের ঋণপত্রের সুদ। এই ঋণপত্র দরকার মতো বেচাকেনা করে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক দেশে নগদের জোগান নিয়ন্ত্রণে রাখে, যে বেচাকেনার পোষাকি নাম ওপেন মার্কেট অপরেশন। দুই, ভারত সরকারের জন্য বাজার থেকে ঋণ তুলে দেওয়ার ফি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ। তিন, তাদের ভাণ্ডারে গচ্ছিত বিদেশি ঋণপত্রের সুদ। বর্তমান বছরে এগুলোর কোনওটিতেই সাংঘাতিক আয় বাড়েনি। অপর পক্ষে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের খরচ-খরচাও যে রাতারাতি ভীষণ কমে গিয়েছে, বলা যাবে না।
তা হলে বাকি রইল ভবিষ্যৎ ঝুঁকির জন্য অর্থসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ঝুঁকি নানা রকম। কোনও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের আর্থিক অবস্থা একেবারে তলানিতে ঠেকলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককেই সেই অবস্থার সামাল দিতে হয়। ব্যাঙ্কদের কাছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কই শেষ ভরসা, ‘লেন্ডার অব লাস্ট রিসর্ট’। এই ভূমিকা সুষ্ঠু ভাবে পালন করার জন্য রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভাণ্ডারে কিছু অর্থসংস্থান করে রাখা জরুরি। আবার দেশের শেয়ার বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ হঠাৎ বেড়ে গেলে বিনিয়োগকারীরা দেশি শেয়ার কেনার জন্য ডলার দিয়ে টাকা কেনেন। ফলে দেশের মধ্যে টাকার জোগান বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির উপক্রম হয়। সেই মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে তখন নিজের ভাণ্ডার থেকে সরকারি ঋণপত্র বিক্রি করে বাজার থেকে উদ্বৃত্ত টাকা তুলে নিতে হয়, অর্থনীতির পরিভাষায় যার নাম স্টেরিলাইজ়েশন। কিন্তু এর ফলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভাণ্ডারে সুদ-উপার্জনকারী ঋণপত্রের পরিমাণ কমে গিয়ে সুদহীন টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আয়ও কমে যায়। এটা আর এক ধরনের ঝুঁকি, যার জন্যেও অর্থসংস্থান করে রাখা দরকার। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়মিত বিদেশি মুদ্রা বেচাকেনা করে টাকার দামকে স্থিতিশীল রাখাটাও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের একটা বড় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভাণ্ডারে যথেষ্ট পরিমাণ সোনা-রুপো এবং বিদেশি মুদ্রা থাকা প্রয়োজন।
এই সব সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের একটা রিজ়ার্ভ ফান্ড বা সংরক্ষিত তহবিল আছে। এর একটা বড় অংশ সোনা-রুপো ও বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার এবং আর একটা বড় অংশ তাদের কন্টিনজেন্সি ফান্ড বা আপৎকালীন তহবিল। ২০০৯ থেকে ২০১৮ এই দশ বছরে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক গড়ে তার মোট সম্পদের ৮.৪৯ শতাংশ তার আপৎকালীন তহবিলে রেখেছে। একই সময় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মোট সম্পদের গড়ে ২৫.৫৮ শতাংশ রাখা হয়েছিল তার সংরক্ষিত তহবিলে।
বিমল জালান কমিটি বলছে, ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য অত বেশি সম্পদ সংরক্ষিত তহবিল বা আপৎকালীন তহবিলে রাখার দরকার নেই। এই সম্পদের একটা অংশ অনায়াসে সরকারকে হস্তান্তর করা যেতে পারে। এতে এক দিকে যেমন সরকার এই পড়ে থাকা সম্পদের একটা দক্ষ ব্যবহার করতে পারবে, অন্য দিকে তেমনই হস্তান্তরের পরেও ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট অর্থ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিলে মজুত থাকবে। জালান কমিটির মতে, আপৎকালীন তহবিলে মোট সম্পদের ৫.৫ শতাংশ থেকে ৬.৫ শতাংশ থাকাটাই যথেষ্ট। আর সংরক্ষিত তহবিলে মোট সম্পদের ২০ শতাংশ থেকে ২৪.৫ শতাংশ রাখলেই চলবে।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ড শুধু যে জালান কমিটির সুপারিশ মেনে নিয়েছে তা-ই নয়, সরকারকে সুবিধে দেওয়ার জন্য সেই সুপারিশ থেকে যতটা নিংড়ে নেওয়া যায়, নিয়েছে। ফলে আপৎকালীন তহবিলে সম্পদের ৫.৫ শতাংশ রাখা ধার্য হয়েছে, জালান কমিটির সুপারিশ মানলে যার থেকে আর নীচে নামা সম্ভব নয়। আবার, এই মুহূর্তে যে হেতু সংরক্ষিত তহবিলে মোট সম্পদের ২৩.৩ শতাংশ রয়েছে, তাই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ড ঠিক করেছে, এ বছর আর সংরক্ষিত তহবিলে নতুন করে অর্থ রাখা হবে না। আপৎকালীন তহবিলে অর্থসংস্থান কমিয়ে দেওয়ার ফলে এবং এ বছরের আয়ের কোনও অংশ সংরক্ষিত তহবিলে না যাওয়ার ফলে ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত হয়েছে, যা সরকারকে হস্তান্তরিত করা হচ্ছে। আপৎকালীন তহবিলে অর্থসংস্থান কমিয়ে দিয়ে ৫২,৬৩৭ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। আর সংরক্ষিত তহবিলে অর্থ না যাওয়ার ফলে এই বছরের পুরো ‘নিট আয়’টাই উদ্বৃত্ত হয়েছে, যার পরিমাণ ১,২৩,৪১৪ কোটি টাকা। দুইয়ের যোগফল হস্তান্তরিত ১,৭৬,০৫১ কোটি টাকা।
ভারতে এখন বৃদ্ধির হার কমেছে, বেড়েছে বেকারত্ব, বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানার সংখ্যা। জিনিসপত্রের চাহিদা নেই, তাই বিনিয়োগ হচ্ছে না, আবার বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে কর্মসংস্থান হচ্ছে না এবং সেই কারণে জিনিসপত্রের চাহিদা নেই। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ক্রমশ আমরা মন্দার দুষ্টচক্রে নিমজ্জিত হচ্ছি। এই অবস্থায় দেশের আর্থিক ক্ষেত্রটিও খুব সুরক্ষিত নেই। কাজেই এখন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সক্রিয় ভূমিকা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। আপৎকালীন তহবিল কমে গেলে কী করে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এই সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে? আসলে, সম্পদের অনুপাত হিসেবে স্থির না করে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে আপৎকালীন তহবিল ধার্য করা উচিত। সেটা দেখলে আপৎকালীন তহবিল কমানোর বদলে বাড়ানো উচিত ছিল।
মোট সংরক্ষিত তহবিলের ব্যাপারেও একই কথা। তহবিলটি মোট সম্পদের অনুপাত হিসেবে স্থিতিশীল রয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু এর মূল কারণ কিছু দিন ধরে টাকার নিরিখে ক্রমাগত ডলারের দাম বাড়ছে, সোনার দাম বাড়ছে, ফলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সংরক্ষিত তহবিলের অন্তর্গত যে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারটি আছে, সেটি টাকার নিরিখে ফুলে ফেঁপে উঠছে। কিন্তু তাতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক বাজারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতার কোনও উন্নতি ঘটছে না। বস্তুত, আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার দামকে ধরে রাখার জন্য রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভাণ্ডারে আরও ডলারের প্রয়োজন ছিল। আয়ের একটা অংশ খরচ করে সেই প্রয়োজন মেটানো যেত। সেটা যখন হল না, তখন আশঙ্কা হয়, ভবিষ্যতে টাকার দাম আরও পড়ে যাবে। আর টাকার দাম আরও পড়ে গেলে তেলের দাম বাড়বে, বাড়বে সাধারণ মানুষের দুর্দশা।
যদি ধরেও নিই, টাকাটা সরকার ভাল কাজেই খরচ করবে, তবু প্রশ্ন থাকে। সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর, তাই স্বল্পমেয়াদে কিছু করে দেখানোর প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে শক্ত। অপর পক্ষে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের লক্ষ্যটা দীর্ঘমেয়াদি। সাধারণের হিতার্থেই দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রাকে উপেক্ষা করা যায় না। সেই কারণে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আরও আর্থিক স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল।
অর্থনীতি বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা