সুদের হার অপরিবর্তিত— রিজার্ভ ব্যাংকের এই ঘোষণা শুনিয়া অরুণ জেটলি এবং তাঁহার সহকর্মীরা বোধ করি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিয়াছেন— যাহা হইবার, তাহাই হইয়াছে। কিংবা— যাহা হইবার নহে, তাহা হয় নাই। রিজার্ভ ব্যাংক সুদের হার কমাইলে অর্থমন্ত্রীর মুখে হাসি ফুটিত, কিন্তু সুদের হার কমিবার আশা ছিল না। কমেও নাই। প্রধানত তিনটি কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ অপরিবর্তিত রাখিয়াছে। এক, মূল্যবৃদ্ধির হার ক্রমশ বাড়িতেছে। দুই, বিশ্ববাজারে পেট্রোলিয়মের দাম চড়িতেছে এবং আরও চড়িবার সম্ভাবনা তৈয়ারি হইয়াছে। তিন, কেন্দ্রীয় সরকারের রাজকোষ ঘাটতির মাত্রা বাজেটের হিসাব ছাড়াইয়া যাইতে পারে। সুদের হার কমাইলে ব্যাংকঋণের চাহিদা বাড়ে, তাহার ফলে বাজারে চাহিদা ও জোগানের ফারাক বাড়ে, সুতরাং মূল্যবৃদ্ধিতে ইন্ধন পড়ে। রিজার্ভ ব্যাংক মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে সতর্ক। সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটারি পলিসি কমিটি সিদ্ধান্ত করিয়াছে: সুদের হার অপরিবর্তিত থাকিবে। বিশ্ব জুড়িয়াই এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ। তাহার উপরে ভারতে সমাজ এবং রাজনীতি মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর। তাহার রাজনৈতিক তাৎপর্য লইয়া রিজার্ভ ব্যাংকের মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নাই, কিন্তু অর্থনীতির পক্ষেও ইহা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা যত প্রবল হয়, ভবিষ্যতে প্রকৃত মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনাও ততই প্রবল হইয়া থাকে। অতএব, রিজার্ভ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা লইয়া প্রশ্ন নাই।
তবে মানিতেই হয়, অর্থমন্ত্রীর দুশ্চিন্তা বিপুল। ভারতীয় অর্থনীতির অভূতপূর্ব উন্নতির লম্বাচওড়া প্রতিশ্রুতি বিতরণ করিয়া নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসিয়াছেন, গদিতে বসিবার পরেও তাঁহার প্রচারের ঢাক থামে নাই। এমনকী নোট বাতিলের বজ্রাঘাত সামলাইতে গিয়া এবং জিএসটির মহড়া লইতে গিয়া অর্থনীতির বিবিধ পরিসরে যখন রীতিমত টালমাটাল, তখনও তিনি স্থির করিয়াছেন, ভাঙিবেন তবু মচকাইবেন না, ফলে গুজরাতের নির্বাচনী প্রচারেও উন্নয়নের বাগাড়ম্বর অব্যাহত। অথচ অর্থনীতির বৃহৎ উল্লম্ফনের লক্ষণগলি এখনও অনুপস্থিত অথবা ক্ষীণ। সম্প্রতি কিঞ্চিৎ উৎপাদনবৃদ্ধির আভাস দেখিয়াই সরকারি কর্তারা যে ভাবে ‘সুদিন আগত ওই’ বলিয়া পাড়া মাথায় করিতেছেন, তাহাই বুঝাইয়া দেয়, তাঁহারা ভাল ফল দেখাইবার জন্য একেবারে মরিয়া। রিজার্ভ ব্যাংকের পরিসংখ্যানেও কিছু সুলক্ষণ আছে— বিনিয়োগের হার সামান্য ঊর্ধ্বমুখী, ব্যাংকঋণের চাহিদাতেও গতির সঞ্চার হইয়াছে। এই লক্ষণ নিতান্ত সাময়িক কি না, সেই সংশয় স্বাভাবিক। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা নরেন্দ্র মোদীকে কতটা পছন্দ করেন, তাহা প্রশ্ন নহে, তাঁহারা কতটা বিনিয়োগ করিবেন তাহার উপরেই অর্থনীতির গতি নির্ভর করিবে। কিন্তু সুলক্ষণ যদি স্থায়ী হয়ও, জিডিপি-র অঙ্কে তাহার প্রভাব পড়িতে সময় লাগিবে। তত সময় ২০১৯ নির্বাচনের আগে মিলিবে কি না, সেই বিষয়ে শাসকের দুশ্চিন্তা অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর ভূমিকায় নিজস্ব মর্যাদা সম্পর্কে অরুণ জেটলি যদি যথেষ্ট সচেতন হন, তবে তাঁহার কর্তব্য প্রধানমন্ত্রীকে একটি অপ্রিয় সত্য জানাইয়া দেওয়া। সেই সত্যটি হইল, ভারতীয় অর্থনীতির যে দ্রুতগতির স্বপ্ন তিনি দেখাইতেছেন, হয়তো নিজেও দেখিতেছেন, বাস্তব হইতে তাহা অনেক দূরে।