অভ্যেসে সব কিছু সয়ে যায়, তা না হলে প্রজাতন্ত্র শব্দটাকে আমরা এমন নির্বিবাদ মেনে নিতে পারতাম না। রিপাবলিক মানে জনসাধারণের আপন তন্ত্র, যে তন্ত্রে রাষ্ট্রের শীর্ষাসনে রাজারানি নেই, আছে নাগরিকরা নিজেরাই। এর মধ্যে প্রজার স্থান কোথায়? পাঠ্যবইয়ে অবশ্য লেখা থাকে, রাজার বিপরীত শব্দ প্রজা। কিন্তু তাই বলে রাজতন্ত্রের উলটো পিঠে প্রজাতন্ত্র বসিয়ে দেওয়া হবে, এ তো নেহাতই মাছি-মারা বুদ্ধি!
তবে হ্যাঁ, নাগরিক যদি নিজেকে প্রজা মনে করে, তা হলে ভুল শব্দটাই ঠিক হয়ে যায়। সে দিক থেকে দেখলে, কী জানি, আমাদের পক্ষে প্রজাতন্ত্র নামটাই হয়তো বা যথাযথ। আমরা নাগরিক নই, প্রজা। গণতন্ত্রের পাঁজি দেখে ভোট দিয়ে আসি, তার পর যাঁদের ভোট দিই তাঁদের প্রজা হয়ে নিশ্চিন্ত দিনযাপন করি, যতক্ষণ না পরের ভোট আসে। তাঁরা সংবৎসর ছড়ি ঘোরান, আমরা তার তালে তালে নাচি। তাঁরা মঞ্চে উঠে বড় বড় কথা বলেন, আমরা নীচে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে শুনি। আমাদের চলার পথে সর্বত্র তাঁদের ছবি শোভা পায়, আমরা মনে মনে নিজের মনকে বলি, ‘নমো করো।’
প্রজা কী চায়? কিসে তার চিত্তে জাগ্রত হয় রাজারানির প্রতি অপার ভক্তি ও শ্রদ্ধা? সহজ উত্তর: ক্ষমতা। ক্ষমতার দাপট তাকে বেমালুম পেড়ে ফেলে, নিজের প্রশ্নহীন আনুগত্যে নিজেই অভিভূত প্রজা বুক চিরে দেখাতে চায়, তার হৃদমাঝারে অধিষ্ঠিত আছেন ক্ষমতাবান অথবা ক্ষমতাবতী। আমাদের নায়কনায়িকারা দাপুটে না হলে তাই আমাদের মন ওঠে না। তাই বলছিলাম, আমাদের রিপাবলিক মানে সত্যিই প্রজাতন্ত্র।
এবং সে প্রজাতন্ত্র রাজপথে সুন্দর। দিল্লির রাজপথে। ইতিহাসের দেবী পরিহাসপ্রিয়া বলে প্রসিদ্ধ, তাঁর অমোঘ মন্ত্রণায় স্থির হয়েছে, ভারতীয় প্রজাতন্ত্র দিবসের বার্ষিক সরকারি নাট্যরঙ্গটি রাজধানীর যে রাস্তায় অভিনীত হবে তার নাম— রাজপথ। একেবারে শুরুতে এ-নাটক অন্য রাস্তায় হত, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই তার পাকা ঠিকানা হয় ইন্ডিয়া গেট শোভিত ওই প্রশস্ত সরণিতে। মহান ভারতের মহান প্রজাতন্ত্রের মহান প্রদর্শনীকে নাটক বলছি বলে দিল্লীশ্বর যদি শূলে চড়ানোর আদেশ দেন, তবে জাহাঁপনাকে সবিনয় বলব, নাটক বস্তুটি কোনও অংশে কম মহান নয়, সে কথা তো তাঁর অজানা নয়, দেশে ও দুনিয়ায় রকমারি মঞ্চে তাঁর দৈনন্দিন বক্তৃতাগুলি শুনলে ভরত মুনি তাঁর নাট্যশাস্ত্রে একটি পরিশিষ্ট সংযোজন করতেন, হয়তো নবরসের ওপরে একটি দশম রসও।
নাটক মানে তো নিছক দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর নয়, তার ভিতরে নিহিত থাকবে গভীর বার্তা, তবেই না সেই প্রদর্শনী সত্যিকারের নাটক হয়ে উঠবে। রাজপথের এই বার্ষিক চলমান প্রদর্শনীতে কোন বার্তা নিহিত থাকে? একটি নয়, প্রদর্শনী আসলে দুটি। এবং তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের, বস্তুত বিপরীত চরিত্রের। এক দিকে থাকে বিভিন্ন রাজ্যের সাংস্কৃতিক আলেখ্য, সচরাচর তার মাধ্যমে পরিবেশিত হয় নিজস্ব লোককৃষ্টির দু’একটি ফসল, শিল্পকৃতিতে সমৃদ্ধ বর্ণময় প্রদর্শনী দর্শকদের নন্দিত করে। অন্য দিকে বিবিধ সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ, দুঃসাহসী কসরত এবং নানান আধুনিক অস্ত্রের সম্ভার, সাঁজোয়া গাড়ি থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। সৌন্দর্য এবং শক্তি, সংস্কৃতি আর শৌর্য, বিনোদন ও প্রতিরক্ষা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে।
এই দ্বৈতসত্তার একটা অর্থ খুব সহজ। প্রতি বছর এ ভাবেই জানিয়ে দেওয়া যে, আমাদের দেশ একই সঙ্গে শক্তিমান এবং সংস্কৃতিমান। আমরা রংতুলিতে আছি, গোলাবারুদেও আছি। পুরনো ভাষা একটু ঘুরিয়ে বললে, আমাদের অন্তর কুসুমের মতো কোমল হলেও বাইরেটা বজ্রের মতো কঠিন। আর নতুন ভাষায় যদি বলি— আমাদের হার্ড পাওয়ারও আছে, সফ্ট পাওয়ারও আছে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এমন একখানা স্লোগান পেলে হয়তো লুফে নেবেন।
কিন্তু স্লোগানের ছক ভেঙে যদি আর একটু ভাবি? শিল্প এবং শৌর্যের এই দ্বৈত প্রদর্শনীর গভীরে হয়তো বা খুঁজে পাব একটি গূঢ় বাণী। নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের অনুজ্ঞা। রাষ্ট্র নাগরিককে নির্দেশ দিচ্ছে, তোমরা নাচগান করো, আহ্লাদে থাকো, তোমাদের রক্ষা করার ভার আমার। আপাতশ্রবণে ভারী সুন্দর, ভারী ভরসার কথা। একটি আদর্শ ব্যবস্থায় এমনটাই তো হওয়া দরকার। কিন্তু আসলে কথাটা ভয়ংকর। কতটা ভয়ংকর, তা আজ আর বলে বোঝানোর দরকার হয় না বোধহয়। প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালনের নামে রাষ্ট্র কীভাবে আমাদের, সাধারণ নাগরিকদের জীবনটাকে লেজা থেকে মুড়ো পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলেছে, তা এখন নিতান্ত পরিষ্কার। প্রাচীন রোমান শাসকরা রুটি এবং সার্কাস দিয়ে লোকজনকে ভুলিয়ে রাখার বিধান দিয়েছিলেন। রুটি তখনও অনেকের কাছেই দুর্লভ ছিল, এখনও সকলের কাছে সুলভ নয়। কিন্তু সার্কাসের সংখ্যা ও বৈচিত্র কোথায় পৌঁছেছে, দেখলে রোমের নায়করা অবাক হয়ে যেতেন।
প্রজাতন্ত্র দিবসের রাজকীয় প্রদর্শনীতেও সার্কাসের ধর্ম অতি স্পষ্ট। এমনকী, মোটরবাইকের দুর্ধর্ষ কেরামতিও সেখানে বাদ যায় না। কিন্তু এমন নিপুণ ভাবে সেই প্রদর্শনীকে সাজানো হয়, যাতে কোটি কোটি দর্শকের মনে রাষ্ট্রের মহিমা একেবারে জলছবি হয়ে যায়। রাষ্ট্র সাঁজোয়া গাড়ি চড়ে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে দুশমনকে ধ্বংস করতে এগিয়ে যায়, আমরা, নাগরিকরা নিশ্চিন্তে সুসজ্জিত ‘ট্যাবলো’ দেখি। দেখে, নিশ্চিন্ত মনে জীবনের সব দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রের পায়ে সঁপে দিই। দাসখত লিখে দিই।
নাগরিক বললাম বুঝি? ভুল হয়েছে। নাগরিক নয়, প্রজা।