রায় পরিবারের বাসভবন। মেদিনীপুর শহরের গোলকুয়াচকে। —নিজস্ব চিত্র
আঠারো শতকের গোড়ায় চন্দ্রকোনার জাড়া রায়-বংশের পণ্ডিত রামদেব ছিলেন বর্ধমান রাজার সভাপণ্ডিত ও দেওয়ান। রামদেব চন্দ্রকোনায় জরিপের কাজে এলে আনতেন পুত্র রামগোপালকে। পিতার মৃত্যুর পরে রামগোপাল দেওয়ান নিযুক্ত হন। জাড়ায় বসবাস শুরু ১৭৪৮ সালে। বর্ধমান রাজের কাজে রামগোপাল বর্ধমানে থাকতেন। চন্দ্রকোনায় রাজকাজ দেখতেন পুত্র মদনমোহন। রাজা তেজশ্চন্দ্র রামগোপালের মৃত্যুর পর মদনমোহনকে দেওয়ান করে জাড়া অঞ্চলে ৬০০ বিঘা জমি দেন। এটাই জাড়া রায়-বংশের প্রথম সম্পত্তি। ১৭৬০ সালে ব্রিটিশদের চাপানো অতিরিক্ত কর দিতে না পারা জমিদারদের সম্পত্তি নিলাম হয়। মদনমোহনের ছেলে রাজীবলোচন তা কেনেন। এই কর্মদক্ষতার জন্য বর্ধমান রাজা ১৮১৪ সালে তাঁকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন। রাজীবলোচন দেওয়ানের চাকরি ছেড়ে জাড়ায় চলে আসেন। এলাকায় উন্নয়নে জোর দেন।
রাজীবলোচনের বন্ধু ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। রামমোহনের জন্মস্থান জাড়ার কাছাকাছি হুগলির রাধানগরে। তখন জাড়া হুগলির অন্তর্গত ছিল। ধর্মপ্রাণ ও দানশীল জমিদার রাজীবলোচন পুরী তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য পথে অতিথিশালা স্থাপন করেন। হুগলি সেতু নির্মাণে ১০ হাজার টাকা দেন। রাজীবলোচনের পুত্র শিবনারায়ণও দানশীল ছিলেন। তিনি জাড়ায় সংস্কৃত টোল ও দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি করেন। ১৮৬৪ সালে দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে বসবাসের জমি দেন। জনসেবামূলক কাজের জন্য সরকার তাঁকে ‘রাজা’উপাধি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি গ্রহণ করেননি। বহু কীর্তির জন্য লোকজন তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন।
রামমোহন রায়ের পুত্র রাধাপ্রসাদ ও রামপ্রসাদের সঙ্গে শিবনারায়ণের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে রামমোহনের মৃত্যুর পর এলাকার লোকজন তাঁর শ্রাদ্ধের বিরোধিতা করেন। কিন্তু শিবনারায়ণ পণ্ডিত ডেকে শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করেন। প্রণব রায়ের ‘মেদিনীপুর: ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিবর্তন’ গ্রন্থে জানা যায়, রাজীবলোচনের পর থেকে চতুর্থ অধঃস্তন পুরুষ পর্যন্ত ৫৩ জন ভাই ও ৪২ জন বোনের অনেকে বিদেশে থাকেন। কয়েকজন আইনজীবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শিবনারায়ণের বৈমাত্রেয় ভাই যোগেন্দ্রচন্দ্র হুগলিতে ওকালতি করতেন। ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুম্বইয়ের গোকুলদাস তেজপাল সংস্কৃতি কলেজে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা থেকে তিনি আমৃত্যু সকল অধিবেশনে যোগদান করেছেন। মেদিনীপুর জেলাবোর্ড ও পুরসভার সদস্যও ছিলেন।
যোগেন্দ্রচন্দ্রের দুই আইনজীবী পুত্রের মধ্যে কিশোরীপতি জেলা জজ কোর্টে ও সাতকড়িপতি হাইকোর্টে ওকালতি করতেন। মেদিনীপুর শহরের গোলকুয়াচকে তাঁদের বাড়িতে কংগ্রেস দলের বিভিন্ন কাজ হত। বাড়িটিকে বলা হত বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের অফিস। ১৯২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী মেদিনীপুর কলেজ মাঠে সভা করে এই বাড়িতে রাত্রিবাস করেন। ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, বীরেন্দ্রনাথ শাসমলও। কিশোরীপতি ও সাতকড়িপতি ওকালতি ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের সম্পাদকও হন কিশোরীপতি। এই পদে তিনি আজীবন ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ৩৭ হাজার কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকের অধিনায়কত্ব করেন কিশোরীপতি। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। আলিপুর জেলে চিত্তরঞ্জন দাশ, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, সুভাষচন্দ্র বসু, আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে ছিলেন তিনি।
১৯৩১ সালের ৭ এপ্রিল জেলাশাসক জেমস পেডি নিহত হলে বাংলার গভর্নর জন এন্ডারসন মেদিনীপুরে এক সভায় বলেন, ‘মেদিনীপুরের সন্ত্রাসবাদীরা মনে হচ্ছে আমাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে; তারা মেদিনীপুরে কোন ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জীবিত থাকতে দেবেন না। বেশ সরকার সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে’। বিপ্লবীদের দমনে ব্রিটিশরা অত্যাচার শুরু করে। বিপ্লবীরাও প্রতিরোধ শুরু করলেন। তাঁদের দমন করতে সরকার মেদিনীপুরে ‘পিটুনি পুলিশ ক্যাম্প’ চালু করে। মেদিনীপুর শহরের গোলকুয়াচকে কিশোরীপতির বাড়ির লোকজনদের উচ্ছেদ করে পুলিশ এই বাড়িতে ক্যাম্প বসায়। কিশোরীপতি স্ত্রী ও নাবালক পুত্রদের নিয়ে ঘরছাড়া হন। মেদিনীপুর শহরে এই পিটুনি পুলিশের খরচ জোগাতে বসে ‘পিটুনি কর’ (পিউনিটিভ ট্যাক্স)। ১২ জুন শহর থেকে ‘পিটুনি পুলিশ’ তুলে নেওয়া হয়। তারও এক বছর পরে বাড়ি ফেরত পান কিশোরীপতি। তমলুক, কাঁথি, মেদিনীপুর শহর ছাড়াও জেলার আরও বহু এলাকায় এই ক্যাম্প ও ট্যাক্স চালু হয়। ১৯৩৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর জেলাশাসক বার্জ নিহত হন। কিশোরীপতিদের মেদিনীপুরে থাকা নিষিদ্ধ হয়। তাঁরা চলে যান হাওড়ায়। এই মামলায় তাঁর নাবালক পুত্র সনাতনকে গ্রেফতার করে আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। সেই সময়ে আন্দোলনকারী কয়েকজনকে ‘স্পেশ্যাল পুলিশ’ হিসাবে নিয়োগ করত ‘পিটুনি পুলিশ’। থানায় বা সরকারি অফিসে তাঁদের ‘ডিউটি’। কাজ নেই, বসার চেয়ারও নেই। সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা। কিশোরীপতি ১৯২৭-৩০ সাল পর্যন্ত মেদিনীপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে তখনকার ঘাটাল-ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে ঝাড়গ্রামের স্বনামধন্য রাজাকে পরাজিত করে তিনি নির্বাচিত হন। কিশোরপতি খুব তামাক খেতেন। তাই নির্বাচনে তাঁর প্রতীক ছিল হুকো। ১৯৪৩ সালে তিনি প্রয়াত হন।
প্রেসিডেন্সির মেধাবী ছাত্র ছিলেন সাতকড়িপতি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জন কার তাঁকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেন। তমলুকের রেজিস্ট্রি অফিসে যোগদান করলেও স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় সরকার তাঁকে রাঁচিতে বদলি করে। কিন্তু সামান্য এক সহকর্মীর অন্যায়ের প্রতিবাদে চাকরি ছেড়ে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন সাতকড়িপতি। পরে কংগ্রেসে যোগদান করে ওকলতি ছাড়েন। ১৯২১ সালে প্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সম্পাদক হন, সভাপতি হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সম্পাদক বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। চিত্তরঞ্জনের নির্দেশে ডিসেম্বরে কলকাতায় আইন অমান্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। জেলেও যান। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জনের নির্দেশে স্বরাজ্য দলের প্রতিনিধি হয়ে কলকাতার বড়বাজার কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। পরাজিত করেন চিত্তরঞ্জনের ভাই বাংলার অ্যাডভোকেট জেনারেল সতীশরঞ্জনকে। আন্দোলনে অত্যধিক পরিশ্রম করে শরীর ভেঙে যায় সাতকড়িপতির। তবুও ডান্ডি অভিযান গাধীঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৩৪ সালে বাংলায় হরিজন সেবক সঙ্ঘের সম্পাদক হন, সভাপতি ছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। পরে কংগ্রেসের দায়িত্ব ছেড়ে আবার হাইকোর্টে ওকালতি হতে শুরু করেন। সাতকড়িপতির ১৯৮৬ সালে মৃত্যু হয়েছিল।
শতাধিক বছরের পুরনো ‘কিশোরী ভবনে’ এখন থাকেন তাঁদের নাতি রবিদাস রায়। বাড়িটি একটি ঐতিহাসিক ক্ষেত্র। কিন্তু ইতিহাস সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
লেখক শিক্ষক এবং প্রাবন্ধিক