মেদিনীপুর শহরে বীরাঙ্গনাদের শ্রদ্ধা। নিজস্ব চিত্র
সময়টা বেশ দীর্ঘ। এক যুগের বেশি। ১৯৩০-৪৪ সাল পর্যন্ত। এই সময়কালে ব্রিটিশ প্রশাসন এবং পুলিশ আন্দোলন ভাঙতে ধর্ষণকে ‘অস্ত্র’ করে ফেলেছিল। ইতিহাসের উল্লেখে জানা যাচ্ছে, এই সময়পর্বে ধর্ষণ-সহ নারী নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা পাঁচশোর বেশি। ৫ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের মহিলা, পুলিশ-সেনার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাননি কেউই। তার সঙ্গেই ছিল গুলি চালানো, ঘর জ্বালানো।
১৯৩০ সালে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ডাকে আইন অমান্য ও লবণ সত্যাগ্রহ শুরু হয়। আন্দোলন ভাঙতে পুলিশও অত্যাচার শুরু করে। জেলার প্রতাপদিঘিতে ১ জুন প্রথম গুলি চালায় পুলিশ। দু’জন শহিদ হন। কাঁথির পিছাবনি এবং তমলুকের নরঘাটে বহু স্বেচ্ছাসেবককে পুলিশ গ্রেফতার করলে আন্দোলন আরও জোরদার হয়। অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী পাঠানো হয়। শুরু হয় নির্মম দমন। গ্রামে গ্রামে ঢুকে পুরুষ এবং মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদের নগ্ন করে পুকুরে ফেলে দেয় তারা। বিবস্ত্র মহিলাদের গভীর রাতে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসে। শিশুরাও অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সবশেষে ঘরে আগুন দিয়ে চলে যেত পুলিশ।
আইন অমান্য আন্দোলনে মেয়েদের যোগদানের সঙ্গেই স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। আন্দোলন তমলুক, কাঁথি, মেদিনীপুর, ঘাটাল মহকুমার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও বিদেশি দ্রব্য বর্জন, কোথাও গাঁধী দিবস পালন, কোথাও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করায় কাঁথির সিন্দুবালা মাইতি, সুখদাময়ী রায়চৌধুরী, গীতা ভৌমিক, সত্যভামা জানা, বিন্দুবালা দাস, প্রভাবতী বন্দ্যোপাধ্যায়, ভগবানপুরের শৈলবালা দাস, মেদিনীপুরের শিক্ষিকা চারুশিলা গোস্বামী, ডেবরার ননিবালা মাইতি, ফুলগেড়িয়ার বিন্দুবালা শাসমল, দাঁতনের কাননবালা পট্টনায়েক, তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা, কুমুদিনী ডাকুয়া, সুভাষিণী বন্দ্যোপাধ্যায়, চারুশীলা জানা-সহ শত শত মহিলাকে পুলিশ গ্রেফতার করে মেদিনীপুর সেন্টাল জেল, প্রেসিডেন্সি জেল, বহরমপুর সেন্টার জেলে পাঠায়। এদের অনেকেই ছিলেন বাল্যবিধবা ও নাবালিকা। আন্দোলনকারীদের উপর নৃশংস অত্যাচারের জন্য বিপ্লবীরা মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারকে বলতেন বাংলার ‘বাস্তিল’।
মেয়েদের উপরে অত্যাচারের উল্লেখ রয়েছে মেদিনীপুর মহিলা কলেজের অধ্যাপক রীনা পালের ‘উইমেন অব মিডনাপুর ইন ইন্ডিয়ান ফ্রিডম স্ট্রাগল’ বইতে। তিনি লিখেছেন, ধর্ষিতাদের মধ্যে ১৯৩০ সালের ১ অক্টোবর আত্মহত্যা করেন নন্দীগ্রামের নেতুরিয়ার বিনোদিনী সাউ। গণধর্ষণে মারা যান চণ্ডীপুরের সিন্ধুবালা মাইতি ও রাশি দাস। শ্রীকৃষ্ণপুরের দুই অন্তঃসত্ত্বা পুঁটিবালা নায়ক ও সিন্ধুবালা প্রধান অত্যাচার সইতে না পেরে সন্তান প্রসব করে ফেলেন। হাদিয়া গ্রামে কুন্তী দাস পালাতে গিয়ে পড়ে যান। মাঠেই তাঁর সন্তানের জন্ম হয়ে যায়। আন্দোলন থেকে মহিলাদের সরাতে প্রশাসন এতটাই মরিয়া ছিল যে জেলাশাসকের সঙ্গে আসা পুলিশবাহিনী পিছাবনির সন্তানসম্ভবা অম্বুকে মহকুমা শাসকের সামনেই ধর্ষণ করে। বিপ্লবীদের বাড়িতে আগুন লাগানোর কাজ করতেন ‘ঘরপোড়া দারগা’ নলিনী রাহা।
অত্যাচার বেশি হয়েছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে। শুধুমাত্র মহিষাদলে ৬৭ জন এবং পটাশপুরের অযোধ্যাপুর, বাসুদেবপু্র, খড়িকাপাটনা, ছোট উদয়পুর, ইচ্ছাবাড়ি, মকরামপুর, টেপরপাড়া, সাতশতমাল, ব্রজবল্লভপুর গ্রামের ৭৫ জন মহিলাকে ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনা ধর্ষণ করে। বহু মহিলা সামাজিক কারণে তাঁদের পরিচয় গোপন রেখেছিলেন। ইচ্ছাবাড়ি গ্রামের ৫ বছরের পুঁটি মাইতি, ৮ বছরের শিখা বেরা, চকধনুর ৮০ বছরের কৈলাসী বেরাও রেহাই পাননি। ’৪২ সালের ২ অক্টোবর পটাশপুরে সেনা আসে। স্বেচ্ছাসেবকদল বাধা দিলে পুলিশ গুলি চালায়। টেপরপাড়ায় ৮ অক্টোবর বাহিনী বাধা পেয়ে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। প্রতাপদিঘি-সহ বিভিন্ন এলাকায় ১৯৪২ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। বহু ধর্ষিতা হিন্দুশাস্ত্র মতে শুদ্ধিকরণের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন।
১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তমলুক থানা দখল করতে গিয়ে বাঙালি পুলিশ অফিসার অনিল ভট্টাচার্যের গুলিতে শহিদ হন মাতঙ্গিনী হাজরা। জেলাশাসক এনএম খান ও তমলুকের মহকুমাশাসক ডব্লিউ এ শেখের নির্দেশে শত শত ধর্ষণ, লুঠ, গৃহদাহ ও অত্যাচারের ঘটনাগুলি ঘটেছিল। ১৯৪৩ সালের ৯ জানুয়ারিতে মহিষাদলের মাসুরিয়া, চকগাজিপুর, চণ্ডীপুর এবং লাক্ষা গ্রামের ৪৪ জন মহিলাকে ধর্ষণ করে দেড়শো সেনা। স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বারাঙ্গনারা। পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে বিপ্লবীদের তাঁরা আশ্রয় দিয়েছেন। আহতদের সেবা করেছেন। তেরাপেখিয়া বাজারের সত্যবতীদেবীর কাছে থানার দারোগারা প্রায় আসতেন। সত্যবতী পুলিশের কাছ থেকে পরিকল্পনা জেনে বিপ্লবীদের জানাতেন।
প্রমথকুমার ত্রিপাঠী, রাধানাথ দাস অধিকারী এবং সনাচরণ বেরার ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে পটাশপুর’, মন্মথনাথ দাসের ‘পটাশপুরের সেকাল-একাল’, নরেন্দ্রনাথ দাসের ‘হিস্ট্রি অব মিডনাপুর’ বইতে নারী নির্যাতনের তথ্য রয়েছে। নরেন্দ্রনাথ দাস লিখেছেন, চারজন সেনা মিলে এক এক জন মহিলাকে ধর্ষণ করেছে, তাঁদের কেউ অন্তঃসত্ত্বা, কেউ ছ’দিনের শিশুর মা, কারও সন্তানের বয়স ১৫ দিন। কেউ নাবালিকা, কেউ বাল্যবিধবা। এরকম এক মহিলা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করতে চেয়েও পারেননি। প্রতাপদিঘি ক্যাম্পে ১৩ বছরের মেয়েকে বেয়নেটের সামনে শুইয়ে ধর্ষণ করেছে একাধিক সেনা। এক মহিলা বাধা দিতে গিয়ে ছুরিকাহত হন। বেশিরভাগ নির্যাতিতাই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাঁদের কেউ আত্মহত্যা করেন, কেউ মারা যান। ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর’ (তৃতীয় খণ্ড) বইতে রাসবিহারী পাল ও হরিপদ মাইতি জানিয়েছেন, অনাহারে রোদে বসিয়ে রাখা, চুল ধরে ঝোলানো, মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নেওয়া, বিবস্ত্র করা, বুকে হাত দেওয়া, গালে কামড়, গোপনাঙ্গে লাথি মারা প্রভৃতি ছিল অত্যাচারের নমুনা। তবুও পিছু হঠেননি মহিলারা। এই ‘হায়না পুলিশে’র হাত থেকে রক্ষা পেতে কুমুদিনী ডাকুয়ার নেতৃত্বে ‘ভগিনী সেনা’ মহিলাদের হাতে ১০ হাজার ধারালো ছুরি তুলে দেয়। তাতে কাজ হয়। অত্যাচার থেকে সরতে থাকে সেনা-পুলিশ।
আন্দোলনে মহিলাদের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রশাসনকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল। তা স্বরাষ্ট্র সচিব ও মুখ্য সচিবের রিপোর্ট থেকে জানা যায়। মুখ্য সচিব লিখেছিলেন, ‘আমাদের বিশেষ সমস্যা যা সমাধান করা খুবই কঠিন তা হল আইন অমান্য আন্দোলনে মহিলাদের সংখ্যা বৃদ্ধি’। হিজলি বন্দিশালা সংলগ্ন সাব-জেলটিকে নারী-কারাগারে পরিণত করা হয়। মেদিনীপুরের আন্দোলন দমনে ব্রিটিশ প্রশাসনের অত্যাচার জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল বলে জওহরলাল নেহরুকে লিখেছিলেন গাঁধী।
স্বাধীনতা দিবসের দিনে এখনও স্মরণ করা হয় আন্দোলনে যোগ দিয়ে সম্ভ্রম হারানো মেয়েদের। কিন্তু সেই বীরাঙ্গনাদের কোনও কোনও প্রজন্ম এখন আর সেই অত্যাচারের পর্ব নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত নন।
লেখক শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক