উত্তম কুমার। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে
আজ ২৪ জুলাই তাঁর মৃত্যুদিন। প্রায় চার দশক আগে, ১৯৮০ সালে মারা যান তিনি। আর এই চল্লিশটি বছর ধরে, একটু একটু করে মৃত্যু ঘটে চলেছে তাঁর অভিনয়ের ইতিহাসের।
প্রতিভা, এমনকি, তার চেয়েও বড় কোনও শব্দ দিয়ে যদি ব্যাখ্যা করা যায় তবে উত্তমকুমার তা-ই। কিন্তু এ কথা আবেগের। যুক্তি দিয়ে, বিশ্লেষণ করে এর প্রমাণ করতে গেলে যে সংগ্রহটি প্রথম জরুরি, তা-ই অনেকাংশে হারিয়ে ফেলেছি আমরা, এই আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি। আগাগোড়া, পূর্বাপর উত্তমকুমার-অভিনীত সব ছবি আজ আর দেখার উপায় নেই। অনেক ছবিরই ‘নেগেটিভ’ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। উত্তম-পাগলামির স্রোতে সে সব খড়কুটোর কথা আমরা মনেই রাখিনি।
উত্তমকুমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো করে সিনেমায় আসেননি। সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের হাত ধরে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশের সুযোগ তাঁর হয়নি। যে উত্তমকুমার ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে প্রথম দেখা দিলেন তাঁর মধ্যে উত্তমকুমার হয়ে ওঠার নিহিত সম্ভাবনার প্রকাশ কতটা দেখা গিয়েছিল, সেটা বলা কঠিন। ২৪ এপ্রিল ১৯৪৮, স্বাধীনতার বছরও গড়ায়নি তখনও, কলকাতার চিত্রা সিনেমাহলে মুক্তি পেয়েছিল সে ছবি। রবীন্দ্রনাথের গল্প, চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সজনীকান্ত দাস। পরিচালনা নীতিন বসুর। ছবির নায়ক উত্তমকুমার ছিলেন না। তাঁর নাম তখন অরুণকুমার। অভিনয়ের একটা নতুন যুগ, নতুন ধারার সম্ভাবনা যদিও বা থেকে থাকে সে ছবিতে তবু তা চাপা পড়ে গিয়েছিল সে কালের দুর্দান্ত সব অভিনেতার অভিনয়ে। অসিতবরণ, ছবি বিশ্বাস, কেতকী দত্তের পাশে নবাগত অরুণকুমার পাত্তা পাবেন কেন!
তার পরের পাঁচ বছরে উত্তমকুমার অভিনয় করলেন মোট ১৯টি ছবিতে—‘কামনা’, ‘মর্যাদা’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘সহযাত্রী’, ‘নষ্টনীড়’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘বসু পরিবার’, ‘কার পাপে’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘লাখ টাকা’, ‘নবীন যাত্রা’, ‘বউঠাকুরানির হাট’, ‘মনের ময়ূর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘চাঁপাডাঙার বউ’, ‘কল্যাণী’, ‘মরণের পরে’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’। পর পর এই ছবিগুলিতে কী ভাবে বদলে যাচ্ছে উত্তমকুমারের অভিনয়, তার পিছনে রয়েছে কী অসীম অধ্যবসায় তার ধারাবাহিক বিচারভিত্তিক সমালোচনা করা সম্ভব নয়। কারণ, এর বেশ কয়েকটি ছবির ‘নেগেটিভ’ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তবে আশার কথা, একক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে উত্তমকুমারের অভিনয়-জীবনের ইতিহাসের নানা উপাদান সংরক্ষিত হয়েছে। যেমন সংরক্ষিত আছে তাঁর অভিনীত ২০২টি ছবিরই পুস্তিকা।
সেই পুস্তিকাগুলিই এখন উত্তম চলচ্চিত্রের ইতিহাস রচনায় আমাদের প্রধান উৎস। সেখান থেকেই দেখা যাচ্ছে, ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি থেকেই সেই অর্থে বলতে গেলে উত্তমকুমারের জয়যাত্রার শুরু। সে ছবিতে অবশ্য শুধু উত্তমকুমার নয়, ছিলেন সুচিত্রা সেনও। সুচিত্রা সেন অবশ্য তার আগেও উত্তমকুমারের সঙ্গে অভিনয় করে এসেছেন। সেই অভিনয় আমরা দেখেছি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে। কিন্তু সে ছবিতে সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমার ঠিক জুটি হয়ে ওঠেননি। একটি তরুণদল যেখানে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সকলেই ছিলেন তার মধ্যে উত্তমকুমার ছিলেন নেতৃস্থানীয়। আর সুচিত্রা সেন ছিলেন সেই তরুণ দলের কিছুটা স্বপ্নের পরির মতো। ফলে, উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনের সিনেমায় প্রেমটা সেখানে ছবির মুখ্য বিষয় নয়, ওই নব তরুণদলের হুল্লোড় তথা কীর্তিকলাপটাই মুখ্য। কিন্তু ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় এসে সুচিত্রা সেনকে আর উত্তমকুমারের সঙ্গে ছিলেন বললে অবশ্য কিছুটা কমিয়ে বলা হয়, সেই প্রথম উত্তম-সুচিত্রা জুটি সাড়া ফেলে দিল বাঙালি দর্শকের মনে।
সেই সাড়া ফেলে দেওয়াটা যে পরবর্তী কালে কী গভীর অভিঘাত তৈরি করবে সেটা বোঝা যায় ইতিহাসের পরবর্তী পাতাগুলোর দিকে তাকালে। উত্তমকুমার বলতেই আজও অনেকের মনে ভেসে ওঠে উত্তম-সুচিত্রা জুটির কথা, যদিও আরও অনেক নায়িকার সঙ্গেই অত্যন্ত সফল ভাবে অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার।
১৯৫৪ সালে সাড়া ফেলে দেওয়া সেই ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে আশাপূর্ণা দেবীর কাহিনি অবলম্বনে চিত্রনাট্য লেখেন নিতাই বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিচালনায় ছিলেন অগ্রদূত, অর্থাৎ, বিভূতি লাহা। ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪, উত্তরা-পূরবী-উজ্জলায় মুক্তি পাওয়া সে ছবিতে অভিনয় করেছিলেন চন্দ্রাবতী, কমল মিত্র, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়, যমুনা সিংহ, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, জহর রায়, অপর্ণা দেবী, অনুপকুমার, শিখারানি বাগ প্রমুখ।
এত জন অভিনেতার নাম এক সঙ্গে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিছক উত্তম-অভিনীত ছবিগুলির সম্পূর্ণ তথ্যচিত্রণ নয়, সেই সময়টা অর্থাৎ, বাংলা ছবির কোন পর্যায়ে উত্তমকুমার অভিনয় করতে এসেছিলেন সেই পর্যায়টাকে কিছুটা পরিচিত করা।
মনে রাখতে হবে উত্তমকুমার যে সময়ে অভিনয় করতে এসেছেন সেই সময়ে বা তার আগে বাংলা ছবিতে ভাল অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভাব ছিল না। উত্তমকুমারের সময়ে যাঁরা প্রধানত পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন তাঁরাও তাঁর আগে যথেষ্ট ভাল অভিনেতা হিসেবে বাংলা সিনেমার দুনিয়া দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু উত্তমকুমারের অভিনয় জীবনের শুরুর কালটা বাংলা সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে একটা সন্ধিকাল বলা যেতে পারে। দীর্ঘ সময়ের ব্রিটিশ শাসন শেষে সবে স্বাধীন হয়েছে ভারত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে ভেঙেচুরে যাচ্ছে পুরনো মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক জীবনেও নেমে আসছে একটা বড় পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনের সময়ে উত্তমকুমারের আবির্ভাব। মধ্যবিত্ত বাঙালি যৌবনের চিন্তাধারা, সমাজচেতনা তখন পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে এক নতুন আশার ভিত্তিভূমি।
এই সব কিছুর সঙ্গেই, সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গেই বদলে যাচ্ছে প্রেমের ধারণাটাও। আর সেই পরিবর্তমান প্রেমের ধারণা খুঁজে বেড়াচ্ছিল এক নতুন ‘রোম্যান্টিক আইডল’কে। বাঙালি যৌবনের সেই ‘রোম্যান্টিক আইডল’ খুঁজে বেড়ানোটা যেন খানিকটা দিশা পেল উত্তমকুমারে এসে। কিন্তু সেই দিশা পাওয়ার বিষয়টাও খুব গভীর সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় ধরার প্রধান বাধা উপাদানের অভাব। উত্তমকুমার-অভিনীত সব কটি ছবি যথাযথ ভাবে ফিরে ফিরে দেখার সুযোগ নেই। নেই তেমন ‘নির্ভরযোগ্য’ জীবনীও।
অতএব, উত্তমকুমার আজও বাঙালির স্মৃতিবিলাসের ‘ম্যাটিনি আইডল’, পূজার ছলে আমরা যাঁকে ভুলেই থাকি।
লেখক উপ পরিচালক, গ্রন্থন বিভাগ, বিশ্বভারতী