ছবি: সংগৃহীত।
সভ্যতার দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু বলতে পারছি না একে। আরও এক বার। তসলিমা নাসরিন আরও এক বার আটকে গেলেন। বস্তুত আটকে দেওয়া হল তাঁকে। মহারাষ্ট্রের এক বিমানবন্দরে নেমেছিলেন। কিন্তু বিমানবন্দরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে শহরে পা রাখতে পারলেন না। পত্রপাঠ ফিরে যেতে হল। নিদারুণ উগ্রতা, কট্টর মৌলবাদ, তীব্র অসহিষ্ণুতা, ঘৃণার রাজনীতি, বিদ্বেষের কারবার— কারণগুলো আমাদের জানাই। এই কারণগুলোই আগেও পথ আটকেছে লেখিকার, এই কারণগুলোই তাঁকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, এই কারণগুলোই তাঁকে বার বার ঠাঁইনাড়া করেছে। তবু এর নিবারণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। একে আমাদের সভ্যতার দুর্বলতা ছাড়া আর কোন নামেই বা ডাকা যেতে পারে?
উগ্রতা যে সর্বদাই বিপজ্জনক, সে তো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু উগ্রতা যখন ধর্মীয় ভাবাবেগ বা ধর্মীয় উন্মাদনার রূপ ধরে আসে, তখন তা সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক। তসলিমা নাসরিন এর একমাত্র শিকার নন। কখনও সলমন রুশদি এর শিকার, কখনও মকবুল ফিদা হুসেন এর শিকার, কখনও ফরাসি পত্রিকা শার্লি এবদো এর শিকার, কখনও এম এম কালবুর্গি এর শিকার। বাদ যাচ্ছেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও।
ধর্মীয় উগ্রতা শুধু সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির উঠোনেই শিকার ধরে, তা-ও নয়। সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা এই একবিংশ শতকে পৌঁছে যে গভীর সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়েছে, অসহিষ্ণুতা নামক সেই সমাজ-রাজনৈতিক সঙ্কটও ধর্মীয় উগ্রতা জনিত। গোটা পৃথিবীর সামনে তথা মানব সভ্যতার সামনে আজ সবচেয়ে বড় বিপদ যে সন্ত্রাসবাদ, তার জন্মও ধর্মীয় উগ্রতার জঠরেই।
ঔরঙ্গাবাদে এক লেখিকাকে ঢুকতে দেওয়া হল না, এ তো হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র। সামাজিকতার একটা নামমাত্র পরতের নীচে নিমজ্জিত অপরিসীম উগ্রতার কালাপাহাড়। নিমজ্জিত হলেও লুক্কায়িত কিন্তু বলব না। কারণ তলায় তলায় এই উগ্রতার বিস্তার কী প্রবল আকার নিয়েছে এবং নিচ্ছে, তা কম-বেশি আমাদের সকলেরই জানা। এর বিপদটা যে একেবারেই আঁচ করতে পারছি না, তেমনও নয়। তবু এর বিরুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত সক্রিয়তা দেখাতে পারছি না। সামাজিক বিপর্যয় যদি হানা দেয়, দায় কিন্তু আমাদের সকলকেই নিতে হবে।