হাঁসদা সৌভেন্দ্রশেখর-এর (ছবিতে) গল্প সংকলন, আদিবাসী উইল নট ডান্স নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। ঝাড়খণ্ড সরকার এটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে; আদিবাসীদের একাংশ লেখকের বিরুদ্ধে সরব, তিনি নাকি আদিবাসী মেয়েদের একটা কৃত্রিম ছবি এঁকেছেন, যা যৌনতায় পরিপূর্ণ; আবার অনেকে বই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন। আমার মনে হয়, পুরো বিতর্কে দুটো প্রধান সমস্যা সামনে আসছে। বিতর্কিত গল্পটির চরিত্র তালামাই-এর সঙ্গে দিকু পুলিশের শারীরিক সম্পর্ক এবং তালামাই-এর সঙ্গে তার খ্রিস্টধর্মের সম্পর্ক। যৌনতা ও ধর্ম, দুটো বিষয়ই সাঁওতাল সমাজে খুবই স্পর্শকাতর এবং দুটোতেই সাঁওতালদের পারম্পরিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই রকম স্পর্শকাতর বিষয়গুলি নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে সংবেদনশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে।
সাঁওতালদের ঐতিহ্য ও সামাজিক ব্যবস্থা বিষয়ে প্রামাণ্য বই, হড়কোরেন মারে হাপড়ামকোরেয়া কাথা (সাঁওতালদের ঐতিহ্য ও প্রতিষ্ঠান) বই-তে সাঁওতাল মুরুব্বি কৈলান হাড়াম বলেছেন, ‘‘সেই আদি থেকেই আমরা খাদ্য, জল আর আমাদের মহিলাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য গুটিপোকার মতো একটা দেশ থেকে আর এক দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’’ হারিয়ে যাওয়া মহিলাদের সন্ধান এবং তাদের রক্ষার জন্য আমরা সেই পরিযায়ী চরিত্র পাই আমাদের দাঁসায় পরবেও, যেখানে সাঁওতাল পুরুষরা দুর্গাপূজার সময় বিভিন্ন গ্রামে নাচ করে বেড়ায়, আসলে তারা বিজাতীয়দের কাছে হারিয়ে যাওয়া মহিলাদের খুঁজতে বাহির হয়।
এক দিন এক জায়গা থেকে অন্যত্র পালাবার জায়গা ছিল। আজ আর পালাবার জায়গা নেই, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির নিয়মেই সাঁওতালরা বিভিন্ন অবিচারের বিরুদ্ধে এখন প্রতিবাদ জানাচ্ছে। নামাল দেশে কাজের স্থানে কোনও মালিক দুর্ব্যবহার করলে তারা তাদের দলনেতার আদেশে প্রতিবাদ জানিয়ে স্থান ত্যাগ করে। পরবর্তী কালে সেই মালিক পুনরায় সেই গ্রামে প্রবেশ করলে সকলে মিলে গণপ্রহার দেওয়ার নজিরও আছে। যদিও তাতে আসল সমস্যার কোনও পরিবর্তন হয়নি। ইদানীং প্রতিবাদের ধরনে পরিবর্তন আসছে। সম্প্রতি রায়গঞ্জ শহরের প্রতিবাদ তার একটি উদাহরণ।
একই রকম ঘটনা নিয়ে সৌভেন্দ্র-র গল্প। গল্পের চরিত্র, তালামাই, যাকে নিয়ে এত বিতর্ক, সেই রাত্রে রেলস্টেশনে দিকু রেলওয়ে পুলিশের কাছে নিজের শরীরটাকে পেতে দেওয়া ছাড়া তার সামনে আর কী-ই বা উপায় ছিল! ভিন্দেশ, অচেনা জায়গা, অজানা ভাষা, যেখানে রক্ষকই ভক্ষক সেখানে প্রতিবাদ করাটাই মূর্খামি। নির্বাক ভাবে সঁপে দেওয়ার মধ্যেও প্রতিবাদ আছে। তার সেই শীতল নিস্তেজ শরীরের মধ্যেও কোথাও জেগে থাকে সেই মানুষের প্রতি বুক ভরা ক্রোধ এবং ঘৃণা।
কিন্তু লেখকের অতি-সরলীকরণে বিষয়টি তার গভীরতা হারিয়েছে।
তেমনি, বইয়ের শেষ গল্প ‘আদিবাসী উইল নট ডান্স’-এ লেখক ধর্মান্তরকরণের মতো জটিল বিষয়টা খুবই সরলীকৃত ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। ধর্মান্তরের ফলে সাঁওতালরা নিজেদের পারম্পরিক ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এনেছেন এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও অস্বীকার করা যায় না যে আধুনিক শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য পরিকল্পিত উন্নয়নের কাজ খ্রিস্টান মিশনারিরাই সাঁওতালদের মধ্যে প্রথম শুরু করেছিলেন। দারিদ্র, অশিক্ষা, রোগ জ্বালায় ওঝা গুনিনদের উপদ্রব, ডাইনি অপবাদে বিশাল অঙ্কের জরিমানা এবং না দিতে পারলে হত্যা পর্যন্ত— এই সকল জ্বালা থেকে মুক্তির জন্য এবং নিজের ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক সাঁওতাল স্বেচ্ছায় ধর্ম পরিবর্তন করে। তার পর নাম পরিবর্তনে কী আসে যায়? সৌভেন্দ্র এই ব্যাপারগুলো মাথায় রাখলে তাঁর কাহিনি অনেক মহত্তর হয়ে উঠতে পারত। বিশেষত, তাঁর কলম আছে। সাঁওতাল সমাজের এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আলোচনার আলোয় তিনি তুলেও এনেছেন, সে কারণে তাঁর কাছে প্রত্যাশা বেশি।
দুর্ভাগ্য, তাঁর বইকে কেন্দ্র করে কে বেশি খাঁটি সাঁওতাল— এটা জাহির করার প্রতিযোগিতা চলছে, সাঁওতালদের প্রচলিত পদ্ধতি ‘গালমারাও’ বা আলোচনা-র যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আছে তার শরণ না নিয়ে আইন-আদালতের পথ নেওয়া হচ্ছে। এই বির্তকিত বই নিয়ে বিভিন্ন মঞ্চে আলোচনা করা যায় কিন্তু বই নিষিদ্ধ করা এবং কারও কণ্ঠ রোধ করা বরং সমাধানের আশাকেও নস্যাৎ করে। রাজনীতি ও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে পুস্তকটি নিষিদ্ধ হওয়ায় অনেকে পুলকিত বোধ করতে পারেন, কিন্তু সার্বিক সাঁওতাল উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটা আত্মঘাতী পদক্ষেপ।