অভিযান: পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে এলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ২০ ডিসেম্বর, বোলপুর। পিটিআই
এমন উর্বর জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা! বঙ্গ-বিজেপির নেতাদের বহু দিনের ক্ষোভ ছিল, দিল্লির এগারো নম্বর অশোক রোডের সদর দফতরের নেতারা বাংলা নিয়ে তেমন মাথা ঘামান না। চেষ্টা করলে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মভূমিতে সোনার কমল ফোটানো যেত। দেশভাগের ইতিহাস, উদ্বাস্তু-শরণার্থী, ৩০ শতাংশের কাছাকাছি মুসলিম জনসংখ্যা, নমশূদ্র থেকে আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ক— বিজেপির রাজনীতির সব উপাদানই পশ্চিমবঙ্গে মজুত। কিন্তু তার পরেও কলকাতার মুরলীধর সেন লেনের নেতারা হতাশ মনে ভাবতেন, দিল্লির নেতারা হিন্দি বলয় ও পশ্চিম ভারতের বাইরের পৃথিবীটা নিয়ে ভাবেনই না।
বলা বাহুল্য, সেই হতাশা আর অবশিষ্ট নেই। আজ জে পি নড্ডা তো পরশু অমিত শাহ, উত্তরবঙ্গে কৈলাস বিজয়বর্গীয় তো রাঢ়বঙ্গে সুনীল দেওধর, এমনকি উজ়বেকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পিছনের পর্দায় দক্ষিণেশ্বরের মন্দির ফুটে উঠছে। বিজেপি নেতৃত্ব যেন সর্বশক্তি দিয়ে বাংলার গদি দখলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
যে কোনও রাজনৈতিক দল ভোটে জিততে চায়। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন: বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গে এ ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কেন?
উত্তর খুঁজতে একটু ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ প্রয়োজন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের প্রাক্কাল। তত দিনে অশোক রোডের পুরনো ঠিকানা থেকে বিজেপির সদর দফতর দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের দুর্গের মতো বাড়িতে উঠে এসেছে। এক কালে শেয়ার বাজারে লগ্নিতে চোস্ত অমিত শাহ হিন্দি বলয়ের লোকসানের আশঙ্কা মাথায় রেখেই বাংলা নিয়ে ভাবনা শুরু করেছিলেন। শেয়ার বাজারে টাকা খাটানোর ভাষায় একে বলে ‘হেজিং’। এক দিকে লোকসান হতে পারে ভেবে অন্য দিকে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা।
কী রকম? ২০১৪-র লোকসভা ভোটে বিজেপি দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, বিহার— এই খাস হিন্দি বলয়ের ২২৬টি আসনের মধ্যে ১৯২টি আসনই জিতেছিল। দিল্লির মসনদ দখলের সেটাই ছিল চাবিকাঠি। কিন্তু ২০১৯-এর ভোটের আগে মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান-ছত্তীসগঢ়ে বিধানসভা ভোটে হেরে যাওয়ায় বিজেপি নেতারা প্রমাদ গোনেন। হিন্দি বলয় থেকে আসন কমতে পারে ভেবে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য থেকে তা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়।
ইচ্ছে থাকলেই তো হল না। সংগঠনের জোর কোথায়! উনিশের লোকসভায় বিজেপি গোটা রাজ্যে মেরেকেটে ৩০ শতাংশ বুথে পোলিং এজেন্ট বসাতে পেরেছিল। কিন্তু ভোটের ফল বেরোনোর পরে দেখা যায়, ৪২টির মধ্যে ১৮টি আসনই বিজেপি জিতে নিয়েছে। আদিবাসী, দলিত, অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ ঢেলে বিজেপিকে ভোট দিলেন। শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, তোলাবাজি, সংখ্যালঘু তোষণ নিয়ে মানুষের জমা অসন্তোষ ভোটের বাক্সে গিয়ে পড়ল। তার ধাক্কায় বাংলা থেকে বিজেপির আসন ২ থেকে একেবারে ১৮-তে গিয়ে পৌঁছল। ২০১৪-র মোদী-ঝড়েও বিজেপি বাংলায় মাত্র ১৭ শতাংশ ভোট কুড়িয়েছিল। ২০১৯-এ সেটাই ৪০ শতাংশ টপকে গেল। বলা যায়, এর পরেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা টের পান মোদী-শাহেরা।
কিন্তু শুধুই নবান্ন দখলের স্বপ্ন নয়। জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতেও বাংলার ভোটে জেতা বিজেপির কাছে এখন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১-এর গ্রীষ্মে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অসম, কেরল, তামিলনাড়ু, পুদুচেরিতে ভোট। এর মধ্যে একমাত্র অসমে এখন বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু সিএএ-এনআরসি নিয়ে অসন্তোষের পরে অসমের ভোটের ফল কী হবে, তা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা। কেরল, তামিলনাড়ু বা পুদুচেরিতে বিজেপি দাঁত ফোটাতে পারলেই যথেষ্ট। তার বেশি কিছু কট্টর ভক্তকুলও আশা করছে না। যার অর্থ, কর্নাটকের বাইরে বিজেপির দাক্ষিণাত্য বিজয়ের স্বপ্ন অধরাই থাকছে। বাকি থাকে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ।
উনিশের লোকসভা ভোটে বিজেপি একাই ৩০৩ আসনে জিতলেও গত দু’বছরে রাজ্যওয়াড়ি বিধানসভা ভোটে বিজেপির ট্র্যাকরেকর্ড মোটেই আহামরি নয়। প্রথম কর্নাটক, তার পরে মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান-ছত্তীসগঢ় থেকে শুরু করে ২০১৮ থেকে বিজেপি ৮টি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে হেরেছে। হরিয়ানায় হেরে গিয়েও সরকার গড়েছে। উনিশের পরেও দিল্লি, ঝাড়খণ্ডে বিজেপিকে হারতে হয়েছে। করোনা-উত্তর কালে বিজেপির জোট বিহারে ফের ক্ষমতায় ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু একেবারে কান ঘেঁষে।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি জিততে পারলে বিজেপির বিধানসভা ভোটে বিধি বামের দশা কাটবে। হিন্দি বলয়ের বাইরে নতুন এলাকায় পা ফেলে বিজেপি কিঞ্চিৎ পেশি প্রদর্শনও করতে পারবে। দক্ষিণ ভারতে না হোক, অন্তত পূর্ব ভারতে গিয়ে বিজেপি ‘হিন্দি বলয়ের পার্টি’-র ‘বদনাম’ ঘুচবে বলে বিজেপি আশা করতে পারে। সর্বোপরি, বঙ্গে বিজেপির উত্থানের সম্ভাবনা বার বার অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া থেকেও বিজেপি নেতাদের মুক্তি মিলতে পারে।
আসলে গোটা ভারতে বিজেপির কেরিয়ার গ্রাফের সঙ্গে বাংলায় বিজেপির কেরিয়ারের কোনও মিল নেই। অন্য সব রাজ্যেই বিজেপির রাজনৈতিক সাফল্যের ভিত তৈরি করে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা তার কোনও শাখা সংগঠনের কাজকর্ম। বাংলার সীমানাবর্তী জেলাগুলিতে আরএসএসের উপস্থিতি কিছু কিছু ছিল। কিন্তু বিজেপি সেটুকুকেও পুঁজি করতে পারেনি। নব্বইয়ের দশকে অযোধ্যায় রামজন্মভূমি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিজেপির নবজাগরণের পরও বাংলায় ঠাঁই মেলেনি। ১৯৯৮-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের সঙ্গেই জোট করে বিজেপি। ১৯৯৯-এর ভোটে দমদমে তপন শিকদার ও কৃষ্ণনগরে সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়ের জয়ের পরেও বিজেপি সেই সাফল্যকে ভিত্তি করে এগোতে পারেনি। জোটের ফয়দা মমতাই কুড়িয়েছিলেন।
বিজেপি নেতারা বলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্যই পশ্চিমবঙ্গের সৃষ্টি। স্বাধীনতার আগে দেশভাগের সময় হিন্দু মহাসভার নেতা হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ বুঝেছিলেন, ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগই কেবলমাত্র বাঙালি হিন্দুদের রক্ষা করতে পারে। না হলে দেশভাগের পরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলায় হিন্দুদের রক্ষা করা মুশকিল হবে। তাই তিনি দাবি তোলেন, বাংলার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলি পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হতে পারে না। কিন্তু বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিও বাংলা ভাগের দাবি-সহ হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গকে ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৪৬-এর প্রাদেশিক সভার নির্বাচনে দেখা যায়, মানুষ হিন্দু মহাসভার থেকে বঙ্গীয় কংগ্রেসের উপরেই বেশি ভরসা করছেন।
১৯৫২-র লোকসভা ভোটে শ্যামাপ্রসাদের ভারতীয় জনসঙ্ঘ পশ্চিমবঙ্গের ৩৬টি আসনের মধ্যে ৬টি আসনে লড়ে দু’টি আসন জিতেছিল। মূলত হিন্দু শরণার্থীদের ভোটে ভর করে। শ্যামাপ্রসাদ নিজে কলকাতা দক্ষিণ-পূর্ব আসন থেকে জেতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে জনসঙ্ঘের প্রভাবও কমতে শুরু করে। পরবর্তী কালে উদ্বাস্তু, শরণার্থী ভোটব্যাঙ্ক চলে যায় বামপন্থীদের জিম্মায়। হিন্দি বলয়ে জনসঙ্ঘ তথা বিজেপি লোহিয়াপন্থীদের সঙ্গে লড়ে কংগ্রেস-বিরোধী পরিসর দখল করেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা সেই পরিসরে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেন। বিজেপি যতই বাংলার মাটি থেকেই ‘সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ’-এর জন্ম বলে দাবি করুক, ‘বাঙালি ভদ্রলোক’-এর সিংহভাগের কাছে বিজেপি অবাঙালি সংস্কৃতির, সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদী পার্টি হয়েই থেকে গিয়েছিল।
এই উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ের পার্টির তকমা ঘোচাতে না পেরেই ২০১৪ ও ২০১৯-এ ভারত জয় সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের বিজেপি বিন্ধ্য পর্বতের ও-পারে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। কর্নাটক বিজেপির দক্ষিণ ভারত জয়ের গেটওয়ে হয়ে উঠবে— এই আশা কর্নাটকের সীমানাতেই আটকে থেকেছে। তেলঙ্গানায় হায়দরাবাদে বিজেপি সম্প্রতি ভাল ফল করেছে। কিন্তু কেরলের পুর-নির্বাচনে বিজেপির ফল বিধানসভা ভোটের জন্য আশা জাগাচ্ছে না। তামিলনাড়ুতেও বিজেপি এখনও উত্তর ভারতের হিন্দি ভাষা নিয়ে মাতামাতি করা পার্টি হিসেবেই পরিচিত। অন্ধ্রপ্রদেশে বিজেপি এখনও ১ শতাংশ ভোটেই আটকে।
বিজেপির প্রথম অবতার হিন্দু মহাসভা বাংলায় শিকড় গাড়তে পারেনি। দ্বিতীয় অবতার জনসঙ্ঘ ব্যর্থ হয়েছে। বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া ফের বঙ্গের সীমানায় হাজির। তৃতীয় অবতারে লক্ষ্যপূরণ হয় কি না, ২০২১-এ সেই উত্তরেরই অপেক্ষা।