রাখালদাস নিজেই গড়ে ফেললেন ইতিহাস

বিশ্বখ্যাত এই মানুষটি কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯০০ সালে এনট্রান্স পাশ করা পর্যন্ত বহরমপুরের রাস্তা ধরেই হেঁটেছেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। লিখছেন সুদীপ জোয়ারদার।

Advertisement

সুদীপ জোয়ারদার

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২০ ০১:০৬
Share:

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

বর্হিবিশ্বে তাঁর পরিচিতি আর ডি ব্যানার্জী নামে। আমাদের কাছে তিনি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারক। ভাবতে ভাল লাগে, নবাবের এই জেলা তাঁরও জেলা। এই জেলাতেই তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা। শুধু কি তাই? ইতিহাসের প্রতি প্রাথমিক ভালবাসা তৈরিও এখানেই। তাঁর জন্মভূমি বহরমপুরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। এই ইতিহাসের মধ্যে বেড়ে উঠতে উঠতে শৈশবেই রাখালদাস বুঝে গিয়েছিলেন ইতিহাসের চিহ্নগুলো ছুঁয়ে দেখাতেই তাঁর আনন্দ। সুতরাং লক্ষ্য স্থির হতে দেরি হয়নি। ইতিহাসকে আশ্রয় করেই তিনি চাইলেন এগিয়ে যেতে। হাতের নাগালে রামদাস সেন, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, পূর্ণচন্দ্র নাহারের মতো এমন কিছু মানুষ ছিলেন যাঁদের দেখে এই কাজে তিনি লাভ করলেন প্রেরণা। ইতিহাস হয়ে উঠল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তার পরে এক দিন নিজেই গড়ে ফেললেন ইতিহাস।

Advertisement

ভাবতে ভাল লাগে, বিশ্বখ্যাত এই মানুষটি কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯০০ সালে এনট্রান্স পাশ করা পর্যন্ত এই শহরের রাস্তা ধরেই হেঁটেছেন। বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডা দিয়েছেন এই শহরেরই নানা জায়গায়। তা ছাড়া যে নবাবসুলভ চালচলন এবং বেপরোয়া স্বভাব তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে, সমস্যাতেও ফেলেছে বারবার তার মূলটা তো এই জেলার আবহাওয়াতেই গড়া।

১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ১৯৩০ সালের ২৩ মে— রাখালদাসের মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবন। কর্মময় বলতে যা বোঝায়, তাই। বাবা মতিলাল ছিলেন বহরমপুর কোর্টের সফল আইনজীবী। ফলে পরিবারে অর্থের অভাব ছিল না। এ দিকে রাখালদাস মতিলালের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কালিমতীর আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র জীবিত সন্তান। ফলে আদরের আধিক্যও ছিল তাঁকে ঘিরে। এনট্রান্স পাস করার আগেই রাখালদাসের বিয়ে হয়ে গেল উত্তরপাড়ার জমিদার নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা কাঞ্চনমালার (যিনি পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে লেখিকা হিসাবে পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেন) সঙ্গে। পড়াশোনা অবশ্য এর জন্য বিঘ্নিত হল না। এনট্রান্স পাশ করেই রাখালদাস উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি দিলেন কলকাতায়। ১৯০৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পাশ করলেন। যদিও এই বছর বাবা মতিলাল পরলোকগমন করায় এবং পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে গন্ডগোলে জড়িয়ে পড়ায় তাঁর পড়াশোনায় সাময়িক ছেদ পড়ল। কিন্তু সব বাধা কাটিয়ে আবার পড়াশোনায় ফিরে এলেন অচিরেই। ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বিএ, ১৯১০ সালে ইতিহাস নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করলেন।

Advertisement

রাখালদাস বিএ পাশ করার আগেই কিন্তু ইতিহাস-দুনিয়ায় মোটামুটি পরিচিত হয়ে গিয়েছেন। ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তাঁর অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা প্রাচীন লেখ ও মুদ্রার ব্যাপারে তিনি যে আর কিছুদিনের মধ্যেই জহুরি হয়ে উঠবেন,তার লক্ষণও ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে তাঁর এই সংক্রান্ত কাজকর্মে। এমন মানুষকে আড়ালে রাখা যায় না। এমএ পাশ করার বছরটিতেই ভারতীয় যাদুঘরের আর্কিওলজিক্যাল বিভাগে কাজ হয়ে গেল রাখালদাসের। ঢুকেছিলেন এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের ডিরেক্টর জেনারেল স্যর জন মার্শাল রাখালদাসের কাজকর্ম দেখে একেবারে মুগ্ধ। পরের বছরেই তাঁকে সার্ভের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট করে দিলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট থেকে ১৯০৭ সালে ওয়েস্টার্ন সার্কেলের সুপার হয়ে চলে গেলেন পুণে অফিসে। এখান থেকেই পরবর্তী ছ’বছর বোম্বাই প্রেসিডেন্সির দূর দূর জায়গায় তাঁর নেতৃত্বেই চলে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান। এই পর্বেই তিনি সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারক।

একক না স্যর জন মার্শালের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে তিনি সিন্ধু সভ্যতা তথা মহেঞ্জাদারোর আবিষ্কারক তা নিয়ে বিতর্ক আছে। পি কে মিশ্র তাঁর ‘Rakhal Das Banerji: The Forgotten Archaelogist’ বইয়ে দাবি করেছেন, ১৯২৪ সালের আগে মার্শাল সে ভাবে মহেঞ্জাদারোর কথা জানতেনই না। পি কে মিশ্রের মতে, ‘Marshall took direct charge of the excavation from winter 1925-26. By that time Banerjee had done all the work a discoverer should have done।’ সুতরাং বর্হিবিশ্ব যাই জানুক আমরা মহেঞ্জাদারোর আবিষ্কর্তা হিসাবে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামই যে ছোটবেলা থেকে বড় ভাবে জেনে এসেছি, জানা থাক সেটাই।

পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয়দের কৃতিত্বকে চেপে দেওয়ার ঘটনা কম নেই। সেদিক থেকে রাখালদাসের ঘটনা সত্যি না হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু এর পরে যা হল, তা অবিশ্বাস্য। যিনি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক কাজকর্মে এত সাফল্য এনে দিলেন, সেই কাজকর্ম থেকেই সরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে ১৯২৬ সালে। সোজা কথায় চাকরি গেল রাখালদাসের। অপ্রমাণিত একটি চুরির অভিযোগে। আসলে সে সময় রাখালদাসের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল তাঁর অফিস। মার্শাল তাঁর গুণমুগ্ধ। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ধুমপান, আড়ালে নিজেকে তাঁর সমকক্ষ ভাবা এবং তা বলে বেড়ানো অফিসের কেউই ভাল ভাবে নিতে পারেনি। তাঁর কর্মচ্যুতির পিছনে এটাও কাজ করেছিল বলে মনে হয়।

কর্মচ্যুতিতে রাখালদাস আর্থিক প্রতিকূলতায় পড়লেন। বিষয়সম্পত্তি কম ছিল না, বেতনও পেতেন প্রচুর। কিন্তু এ সবের সঙ্গে তাঁর খরচের বহরও ছিল দেখার মতো। বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে আড্ডা খানাপিনা বাড়িতে লেগেই থাকত। আর চালচলনে তো ছোটবেলা থেকেই নবাবিয়ানা। যে সময় টাকায় এক মণ চাল, সে সময় রেলস্টেশনে কুলিকে তিনি অবলীলায় দশ টাকা বখশিস দিয়ে দেন।

আর্থিক অসুবিধার সঙ্গে যুক্ত হল শারীরিক প্রতিকূলতাও। ডায়াবেটিস ধরা পড়েছিল আগেই। এ বার তা একেবারে কাহিল করে দিল। এই অবস্থায় উড়িষ্যার ইতিহাস লেখার কাজ পেয়ে কিছুটা আর্থিক সুরাহা হল। এর পরে ১৯২৮ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ‘মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রফেসর’ হিসাবে তিনি নিযুক্ত হলেন। তবে এই কাজে সম্মান যতটা ছিল, অর্থ ততটা ছিল না। বিশেষ করে রাখালদাসের মতো খরচে মানুষের পক্ষে। এ দিকে শরীর ভাঙছে দ্রুত। এর সঙ্গে বড় ছেলের অকাল প্রয়াণের শোক আর সামলাতে পারলেন না রাখালদাস। একজন অসুখী আর উদ্বিগ্ন মানুষ হিসাবে প্রয়াত হলেন দু’বছরের মধ্যেই।

অনেক কাজ অসমাপ্ত থেকে গেল। তবে যা করে গেলেন সেটাও কম নয়। মহেঞ্জাদারো-সহ নানা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে অংশগ্রহণ করা তো আছেই সেই সঙ্গে রয়েছে প্রচুর গবেষণামূলক বইপত্র, ঐতিহাসিক, সামাজিক উপন্যাস। তাঁর দুখণ্ডে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’; ‘পাষাণের কথা’, ‘শশাঙ্ক’, ‘ধর্মপাল’ ইত্যাদি সুখপাঠ্য, তথ্যানুগ ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি আজও পড়তে ভাল লাগে। কিন্তু গবেষণার প্রয়োজন ছাড়া এ সব উলটে দেখার আর সময় কই বাঙালির? বইয়ে তাই ধুলো জমে। ধুলো জমে মানুষটার ছবিতেও। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন, মৃত্যুদিন চলে যায় নীরবে।

শিক্ষক,ভগবানগোলা হাইস্কুল

তথ্যঋণ: Rakhaldas Bandyopadhyay by Asok K. Bhattacharya

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement