অভিবাসী শ্রমিকদের ঘরমুখো স্রোত দেখে ছেলেবেলার একটা বইয়ের স্মৃতি ফিরে এল: রবীন্দ্রনাথের ‘ছড়ার ছবি’তে একদা কারখানার শ্রমিক মাধোর বৌ-বাচ্চা নিয়ে পথে নামা। (সঙ্গে বইটি থেকে নেওয়া সেই ছবি, শিল্পী: নন্দলাল বসু।) আজকের কর্মহারাদের জামাকাপড়ের হাল একটু ভাল; তাঁদের পথে নামার কারণও আলাদা, আবার আলাদা নয়। মাধোদের বিপর্যয়ের মূলে ছিল ‘পাটের বাজার নরম’ হয়ে কারখানার দুরবস্থা, মাইনায় টান। এ বারও সেই ব্যাপার, অনুঘটক একটা অতিমারি এই যা তফাত। অভিযাত্রীদের গন্তব্যও বদলায়নি: ‘যে দেশ থেকে দেশ গেছে তার মুছে’। এই মানুষগুলি কি সত্যি ভারতকে তাঁদের দেশ বলে ভাবতে পারেন, যেমন ভাবি আমরা, আমাদের নেতারা? না কি যে রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা জানার সুযোগ পাননি, তাঁর কথাই অজান্তে তাঁদের মনে জেগে উঠছে: ‘মহামারী দুর্ভিক্ষ প্রভৃতিতে আমরা যখন অত্যন্ত উৎপীড়িত হইয়াছিলাম সেই সময় হঠাৎ আমাদের গবর্মেণ্টের যেরূপ চেহারা বাহির হইয়াছিল তাহাতে বুঝিয়াছিলাম আমরা তাঁহাদের আপনার নহি।’
এক ভূখণ্ডে হলেও অভিবাসীদের দেশ ভিনগ্রহে। সেখান থেকে তাঁরা যক্ষপুরীতে কাজ করতে আসেন, বিপদে সেখানেই ফিরতে চান। ‘রক্তকরবী’র বিশু বলে, ‘বললুম দেশে যাব, শরীর বড় খারাপ। সর্দার বললেন, আহা, এত খারাপ শরীর নিয়ে দেশে যাবেই বা কেমন করে। তবু চেষ্টা দেখ।’ সত্যিই ফেরা যায় না, ‘যক্ষপুরীর কবলের মধ্যে ঢুকলে তার হাঁ বন্ধ হয়ে যায়।’ এটাও আজকাল একটু ঘুরপথে হচ্ছে, দেড় মাস আধমরা হয়ে সত্যিই শেষ সম্বল খুইয়ে দেশে ফিরছেন শ্রমিকেরা। যক্ষপুরীর কবল থেকে তা বলে মুক্তি নেই: সেখানেই ফিরতে হবে, নইলে খাবেন কী? সারবন্দি মানুষগুলি— খাবারের লাইনে, বাসের লাইনে, পদাতিকের কাতারেও যেন লাইন দিয়ে— ‘রক্তকরবী’র ৪৭ফ আর ৬৯ঙ-র সগোত্রীয়: ‘গাঁয়ে ছিলাম মানুষ, এখানে হয়েছি দশপঁচিশের ছক।’
আমি সাহিত্যের পেশাদার পাঠক। লকডাউনের অবসরে আত্মীয়বন্ধুরা সাহিত্য পড়ে দুঃসময়ে মন ভাল করতে চান। ফোন আসে, নানা লেখক নিয়ে, রবীন্দ্রনাথ তো বটেই। বানিয়ে বলছি না, এক জন শেকসপিয়রের নাটকে ফুলের বর্ণনা খুঁজছেন। কী করে বোঝাই, ফুল পাপড়ি পুষ্পবৃষ্টি সৈন্যসামন্তদের মানায়, পদ্যের মাস্টারের পক্ষে আদিখ্যেতা। আরও বড় কথা, সার্থক কবিরা আমাদের মন ভাল করার জন্য লেখেন না। রবীন্দ্রনাথ পড়লে, বা দান্তে, বা শেক্সপিয়র, কখনও রাগ কখনও দুঃখ কখনও হতাশা হয়, নানা জটিল চিন্তা মনে ঘুরপাক খায়। আনন্দ প্রশান্তি মায় স্রেফ মজাও প্রচুর। কিন্তু আর সব কিছু লুকিয়ে-ছাপিয়ে নয়।
রবীন্দ্রভূমির এক ভাগ কাব্য আর তিন ভাগ গদ্য। চিন্তা ব্যাখ্যা বাস্তববোধ তাঁর প্রতিভার বুনিয়াদ; সেই মাটি থেকে উঠে আকাশ ছুঁয়েছে তাঁর কল্পনা, ভাবাদর্শ, বিশ্বচেতনা। তাঁর দেবতা মন্দির ছেড়ে মাঠে চাষ করেন, রাস্তার ধারে পাথর ভাঙেন। শেষ অবধি দেবতার মধ্যস্থতা লাগে না, কবি নিজেই পৌঁছে যান সেই পরম বাস্তব মানসলোকে: ‘মাটির পৃথিবীপানে আঁখি মেলি যবে/ দেখি সেথা কলকলরবে/ বিপুল জনতা চলে/ নানা পথে নানা দলে দলে/ যুগযুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে/ জীবনে মরণে।’
এ বার পঁচিশে বৈশাখে তাই কেজো রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা যাক। সবাই জানি তিনি বরাবর বলে এসেছেন, কেবল ব্রিটিশদের থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলে আমরা উদ্ধার হব না, প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য চাই মনের মুক্তি ও সমাজের পুনর্গঠন। তাঁর আর একটা চিন্তাও বহুখ্যাত: ভারতীয় ঐতিহ্যে পাশ্চাত্য ‘নেশন’-এর ধারণাটা নেই; আমাদের সাবেক জনজীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে ‘সমাজ’। নেশনের কার্যবাহী অবতার স্টেট: ‘য়ুরোপের শক্তির ভাণ্ডার স্টেট অর্থাৎ সরকার; ... আমাদের দেশে কল্যাণশক্তি সমাজের মধ্যে।’ তিনি আরও বলেছেন, পাশ্চাত্যে পাবলিক বলে একটা সত্তা আছে, অর্থাৎ জনসাধারণের সক্রিয় সমবেত রূপ যা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করতে পারে। ভারতে তার অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল এক ‘ফাঁকি পবলিক’।
ব্যাপারটা তা হলে এই। পাশ্চাত্যের প্রভাবে ও শাসনে ভারতে রাষ্ট্রের, অতএব সরকারের, একটা ধারণা চালু আছে কিন্তু সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি; অথচ এর ফলে চিরন্তন সামাজিক শক্তির অবক্ষয় ঘটেছে। যে পাবলিকের ভূমিকা রাষ্ট্রকে কার্যকর ও সুনিয়ন্ত্রিত করতে পারত, সমাজকেও পুনরুজ্জীবিত করতে পারত, সেই পাবলিক কার্যত অনুপস্থিত। বিশ শতকের প্রথমার্ধে রবীন্দ্রনাথ সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার এই যে কাঠামো তৈরি করে গেছেন, একুশ শতকের ভারতে তা কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, বিস্ময়কর ভাবে অপরিবর্তিত। আজ সঙ্কটকালে তা যেন বেশি করে প্রকট, অসুস্থ শরীরে যেমন শিরা ফুলে ওঠে।
সঙ্কট বলতে অতিমারি বোঝাচ্ছি না। সেটা উপলক্ষ, আসল সঙ্কট মানবিক; তার উৎপত্তি অনেক দিনের, অতিমারির আড়ালে বরং গা ঢাকা দিয়ে নীরবে স্ফীত হচ্ছে। সেই অমঙ্গলের স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ সে যুগেই চিনেছেন ও চিনিয়েছেন, তাই দুর্দিনেও তিনি প্রাসঙ্গিক। অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা তাঁর ভাষায় ফুটে উঠতে পারে, এই প্রবন্ধের শুরুতে যেমন দেখেছি। অতিমারির ফলে যে দেশজোড়া বিতর্ক অমীমাংসিত রয়ে গেল, সেই ভারতে বসবাসের অধিকার নিয়ে তিনি দৃপ্ত ও আপসহীন: ‘সেই ভারতবর্ষ সমস্ত মানুষের ভারতবর্ষ ... সেই অখণ্ড প্রকাণ্ড ‘আমরা’র মধ্যে যে-কেহই মিলিত হউক, তাহার মধ্যে হিন্দু মুসলমান ইংরেজ অথবা আরও যে-কেহ আসিয়াই এক হউক না, তাহারাই হুকুম করিবার অধিকার পাইবে এখানে কে থাকিবে আর কে না থাকিবে।’
‘আমার কবিতা, জানি আমি,/ গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।’ আজকের ক্ষমতাবানদের কানে তা পৌঁছনোর সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবু আশা থাকে, বরফ জমা সারা হলে নদী না হোক নালা গড়িয়ে এক-আধটু জল গলবে। হয়তো আঁচ হবে, প্রচারপত্রে উদ্ধৃত ‘হ্বেয়ার দ্য মাইন্ড ইজ় উইদাউট ফিয়ার’-এর মসৃণ আপ্তবাক্যে টেগোরের মহিমা নিঃশেষিত হয়নি, ওটা সর্বংসহা শিরোনাম গীতাঞ্জলি-র অন্তর্ভুক্তই নয়। বদলে সেখানে আছে ‘ভারততীর্থ’র মতো গোলমেলে কবিতা (‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য,/ হিন্দু মুসলমান’), আছে ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’, সমাজকে উত্যক্ত করা আরও রচনা: ‘অহংকার তো পায় না নাগাল যেথায় তুমি ফের/ রিক্তভূষণ দীনদরিদ্র সাজে—/ সবার পিছে, সবার নিচে,/ সব-হারাদের মাঝে।’ অনুবাদের ‘হেভন অব ফ্রিডম’-এর বেয়াড়া মূল পাঠটাও হয়তো গোচরে আসবে: ‘নিজহস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,/ ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।’
স্বর্গে ঢোকাতেও মারধর করতে হয়, এমন হতভাগার দল ক’টা আছে? ভগবানের হাতে অনেক কাজ, এটা তিনি রবীন্দ্রনাথকে আউটসোর্স করতে পারেন। কেউ পারলে রবি ঠাকুর পারবেন।
এমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়