ছবি: রয়টার্স।
মহাকাশযানের নাম স্পুটনিক, ভ্যাকসিনের নামও স্পুটনিক। স্পষ্টতই, নামটি রাজনীতির হাতিয়ার। ঠান্ডা লড়াইয়ের রাজনীতি। সেই লড়াইয়ের অবসান হইয়াছে, অন্তত তাহার পুরাতন চেহারায়, কিন্তু স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের নূতন কাহিনি দেখাইয়া দিল, বিড়াল চলিয়া গেলেও তাহার হাসি থাকিয়া যাইতে পারে। দুনিয়ার প্রথম কোভিড-১৯ প্রতিরোধক আবিষ্কারের কৃতিত্ব দাবি করিবার ব্যগ্রতায় ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতিস্পর্ধার স্বরূপটিকে চিনিয়া লইতে এমনিতেও কোনও অসুবিধা ছিল না, কিন্তু এই বিষয়ে কাহারও বিন্দুমাত্র সংশয় থাকিলেও ওই নামটি সেই সংশয়কে সম্পূর্ণ নির্মূল করিবার পক্ষে যথেষ্ট। তদুপরি, রুশ প্রচারযন্ত্রীরাও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করিয়া চলিয়াছেন: শৃণ্বন্তু বিশ্বে, আমরা পারিয়াছি, কারণ আমরা পারি। অর্থাৎ— পঞ্চাশের দশকে মহাকাশ অভিযানের দৌড়ে আমরা চ্যাম্পিয়ন হইয়াছিলাম, সাত দশক পরে ভ্যাকসিন তৈয়ারের দৌড়েও আমরাই চ্যাম্পিয়ন।
প্রশ্ন চ্যাম্পিয়ন মানে না। প্রথম এবং প্রধান প্রশ্ন: একটি নূতন ভ্যাকসিনকে স্বীকৃতি দিবার আন্তর্জাতিক বিধিনিয়ম না মানিয়া স্পুটনিক-ভি পঞ্জিভুক্ত করা হইল কী করিয়া? কোভিড-১৯’এর প্রতিরোধক তৈয়ারের জন্য পৃথিবী জুড়িয়া দেড়শোর বেশি গবেষণা চলিতেছে, তাহাদের মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পে মানবদেহে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ-পরীক্ষার তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পর্যায় চলিতেছে। এই সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া এই বছরের শেষে বা আগামী বছরের প্রথমার্ধে এক বা একাধিক প্রতিরোধক ‘বাজার’-এ আসিবে, সেই আশায় দুনিয়ার মানুষ বুক বাঁধিয়াছেন। রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি তৃতীয় স্তরের পরীক্ষা সমাধা করিয়াছে, এমন দাবি তাহার গবেষকরা নিজেরাও করেন নাই। এমনকি দ্বিতীয় স্তরের পরীক্ষা সুসম্পন্ন হইয়াছে কি না, তাহা লইয়াও সংশয় আছে। স্বভাবতই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এই ভ্যাকসিনকে চলমান পরীক্ষার তালিকাতেই রাখিয়াছে, এবং প্রথম সারিতে নহে। অথচ ‘আমরা চ্যাম্পিয়ন’ ঘোষণা হইয়া গেল!
রুশ ভ্যাকসিনের প্রচারকরা দাবি করিতেছেন, সেই দেশ ভাইরাস সংক্রান্ত গবেষণায় বরাবরই অগ্রণী, তাহার ফলেই গবেষণা দ্রুত সফল হইয়াছে। তাঁহাদের দাবি একশো শতাংশ নির্ভুল হইলেও সংশয় এক শতাংশ কমিবার নহে। প্রতিরোধক বা ঔষধ যথাযথ হইলে চলে না, তাহাকে কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণের স্বীকৃত প্রক্রিয়াগুলি ষোলো আনা অনুসরণ করিতে হয়। স্পুটনিক-ভি যদি ভবিষ্যতে সফল প্রমাণিত হয়, তথাপি পুতিনের সিদ্ধান্তটি অন্যায়। নিয়ম না মানিয়া ভ্যাকসিন প্রবর্তনের উদ্যোগ কেবল দেশের ও দুনিয়ার মানুষের জীবনে বড় বিপদের সম্ভাবনাই তৈয়ার করে নাই, চিকিৎসা তথা বিজ্ঞান গবেষণার সুষ্ঠু আয়োজনেও বিশৃঙ্খলার বীজ বপন করিয়াছে। অতিমারির মোকাবিলায় দ্রুত অগ্রসর হইবার তাড়নায় নিয়মের এতটুকু ব্যত্যয় এক বার মানিয়া লইলে তাহা বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা উত্তরোত্তর বাড়াইয়া তুলিতে পারে। গবেষক, ব্যবসায়ী তথা রাষ্ট্রনেতারা পুতিনের দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হইয়া চটজলদি সমাধানে উৎসাহী হইতে পারেন। তাহার পরিণাম ভয়াবহ। রুশ রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বচ্ছতা যৎসামান্য, সরকারের উপর স্বাধীন স্বশাসিত বিবিধ প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের যে নিরন্তর নজরদারি প্রকৃত গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত, তাহা স্তালিনের কালেও ছিল না, পুতিনের কালেও নাই। সেই কারণেই উদ্বেগ দ্বিগুণ। বস্তুত, দুনিয়ার নানা দেশেই এখন রাষ্ট্রচালকরা গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতাকে জলাঞ্জলি দিয়া ঘোষণা করিতেছেন, ‘যাহা বলিতেছি, বিনা প্রশ্নে মানিয়া লও’। এই গুরুবাদী ক্ষমতার দাপটে বলি হইতেছে প্রশ্ন করিবার স্বাধীনতা এবং নিয়ম মানিয়া চলিবার রীতি। ক্ষেত্রবিশেষে তাহা প্রাণঘাতী হইতে পারে। গণতন্ত্রের সঙ্কট পর্যবসিত হইতে পারে নাগরিকদের জীবন-মৃত্যুর সঙ্কটে।