ছবি: সংগৃহীত
জোধপুরের উমেদ ভবন শহরের গর্ব। সেটি নব্বই বছর আগে নির্মাণ করেছিলেন মহারাজা উমেদ সিংহ। রাজ্যে তখন দুর্ভিক্ষ। কিন্তু ভাবা হল, এ সময়ে প্রাসাদ নির্মাণ মোটেই অমানবিক অপচয় নয়, বরং রাজধর্ম পালন, কারণ এতে বুভুক্ষু প্রজাদের রুজি জুটবে।
দিনকাল পাল্টেছে। আমাদের চিন্তার পরিধি একটা ছোট রাজ্য নয়, গোটা ভারত; ঔপনিবেশিক যুগের সামন্ততন্ত্র নয়, স্বাধীন গণরাজ্য। সম ভাবে ১৩৮ কোটি দেশবাসীর কথা ভাবতে হবে। কথাগুলো মনে হল ভারতের বর্তমান শাসকদের এক সিদ্ধান্তে। তাঁদের শখ, নতুন দিল্লির কেন্দ্রস্থলে তাঁরা নতুনতর রাজধানী গড়বেন। থাকবে নতুন সংসদ সৌধ, দশটি প্রশাসনিক ভবন, উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর উন্নততর বাসভবন ইত্যাদি। এই ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ প্রকল্পে প্রথম বরাদ্দ আগামী চার বছরে ২০,০০০ কোটি টাকা। নতুন সংসদ ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন হবে ২০২২ সালে, স্বাধীনতার ৭৫তম জয়ন্তীতে।
এই অঙ্কে মোট খরচের কতটা ধরা আছে, স্পষ্ট নয় (কেবল সংসদ ভবন নির্মাণের বরাদ্দ ৯২২ কোটি)। শুধু বাড়ি তো নয়— আসবাব, পরিকাঠামো সবই চাই রাজকার্য ও রাষ্ট্রীয় মহিমার উপযুক্ত। শোনা যাচ্ছে, সংসদ ভবন জুড়ে থাকবে ঐতিহ্যবাহী দেওয়ালচিত্র, কার্পেট হবে বিশেষ নকশার। পুরনো বাড়িগুলি ভাঙা হবে না, কারণ সেগুলিও ঐতিহ্যবাহী; সেখানে হবে সংগ্রহশালা বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, তারও খরচ আছে। চূড়ান্ত অঙ্কটা পঞ্চাশ-ষাট হাজার কোটিতে পৌঁছতে বাধ্য, ছাড়াতেও পারে। সংসদ ভবনের আনুমানিক খরচ আরম্ভের আগেই বেড়েছে ১৯ শতাংশ। তবে বাড়িভাড়া বাবদ বর্তমানে বছরে হাজার কোটি টাকা খরচ হয়, সেটা বাঁচবে।
সংসদে কথা উঠেছিল, দেশের এই দুর্দিনে এতগুলো টাকা কি এ ভাবে খরচ করা উচিত? তাতে সংসদীয়মন্ত্রী বিরোধীদের কটাক্ষ করেছেন, “তোমরাই তো বলছ, অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সরকারের এখন টাকা খরচ করা দরকার।” তা একশো বার, কিন্তু ঠিক এ ভাবেই কি না, সে প্রশ্ন অসঙ্গত নয়।
প্রকল্পটা নিয়ে তিন রকমের প্রশ্ন উঠেছে। একটা করছেন স্থপতির দল। এমন নজরকাড়া কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে তাঁদের অবশ্যই নানা মত; তবে সকলেই চান, একটা কিছু হোক। প্রকল্প আদৌ হওয়াতেই যাঁদের আপত্তি, তাঁদের অনেকে পরিবেশ ও নগরায়ণের প্রশ্ন তুলছেন। তৃতীয় দলের আপত্তি খরচ নিয়ে। তাঁদের বক্তব্য, বর্তমান ভবনগুলি মোটেই মলিন জরাজীর্ণ নয়, বরং জমকালো ও ঐতিহ্যময়। এ দিকে উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক নানা খাতে টাকা জোটে না, তাতে দেশের ক্ষতি আর গৌরবহানি হচ্ছে; এই অর্থ সেখানে খরচ হোক। অতিমারির পর এমন যুক্তি বহু গুণ প্রবল হয়েছে, বলা বাহুল্য।
আগে ২০,০০০ কোটি নিয়েই ভাবা যাক। দেশে মহামারি রোধের জন্য ধরা হয়েছে ১৫,০০০ কোটি টাকা, সেটা চার বছর কালে দ্বিগুণ করা যেত (একটি সংস্থার হিসেবে, গড়া যেত এমস-এর মানের আরও ১৫টি হাসপাতাল)। অতিমারিতে বিধবা, বয়স্ক ইত্যাদি মানুষের মধ্যে এককালীন ত্রাণ বিতরণ হয়েছে ৩,০০০ কোটি, চার বছর ধরে তার দেড়গুণ দেওয়া যেত। জনধন যোজনার মহিলা সদস্যরা তিন মাস ৫০০ টাকা করে পেয়েছেন, পুরুষরা এক পয়সাও না; এখানেও আরও উদার হওয়া যেত। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকদের ঋণের বদলে অনুদান দেওয়া যেত।
দেশ-বিদেশের প্রায় সব অর্থনীতিবিদ একমত, আজ আশু প্রয়োজন সাধারণ মানুষের হাতে কিছু টাকা স্রেফ সাহায্য হিসেবে তুলে দেওয়া— কেবল অর্থনীতি চাঙ্গা করতে নয়, ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে। সরকার কিন্তু বদ্ধপরিকর, তারা খয়রাতি দেবে না। একশো দিনের কাজে মানুষ তবু গতর খাটিয়ে রোজগার করে, তাই কোনও মতে দুর্ভিক্ষ ঠেকিয়ে সরকারের মুখরক্ষা হচ্ছে। সেটার বরাদ্দ কিছু বেড়েছে, এই টাকায় আরও বাড়ানো যেত। রাজ্যগুলির যে পাওনা ঈশ্বর কেড়ে নিলেন, তার একটা অংশ পুষিয়ে দেওয়া যেত (মনে রাখবেন, সেন্ট্রাল ভিস্টার খরচ ৬০,০০০ কোটি বা তারও উপরে চড়তে পারে)। আমপান-ত্রাণের মতো আঞ্চলিক প্রসঙ্গ না-ই তুললাম।
হিসেব দিয়ে লেখা আর মন ভারাক্রান্ত করব না। ভারতে, বিশেষত অতিমারির ভারতে, একান্ত মৌলিক জনস্বার্থে অর্থব্যয়ের অশেষ দাবি, বিশ বছরের রাজস্বে মেটার নয়। আজ চরম সঙ্কটকালে প্রতিটি বাড়তি সংস্থানের মূল্য আছে। এ ক্ষেত্রে অঙ্কটা নগণ্য নয়। প্রশ্ন কেবল হিসেবের নয়, শোভনতার, ঔচিত্যের, শেষ বিচারে মনুষ্যত্বের।
সঙ্গতি থাকলেও দুর্ভিক্ষের সময় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোক সর্বসমক্ষে পোলাও মাংস খায় না। সাংসদরা তাঁদের পারিশ্রমিকের কিছু অংশ ত্যাগ করে সেই শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। নতুন ভবনের মায়াও যদি সাময়িক ভাবে ত্যাগ করেন, দেশবাসীদের পক্ষে তাঁদের সমীহ করতে সুবিধা হবে। নির্বাচনী সংস্কারের ফলে ২০২৬ সালে সত্যিই আরও বড় সংসদ ভবনের দরকার হবে। তত দিনে অবস্থার উন্নতি হবে আশা করা যায়; তার দায়িত্ব বহুলাংশে সাংসদদেরই হাতে।
অনুমান, নতুন সংসদ নির্মাণে ২০,০০০ কর্মসংস্থান হবে; বুলেট ট্রেনের কাজে হবে ৯০,০০০। নির্মাণ ফুরানোর পর? জনপ্রকল্পে বৃহৎ লগ্নি সত্যি সার্থক হয়, যখন তা থেকে স্থায়ী ভাবে প্রচুর লোকে লাভবান হন। সংসদের কর্মকাণ্ডে নিশ্চয় গণরাজ্যের প্রতিটি নাগরিকের লাভ (বুলেট ট্রেনে নয়)। গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত কিন্তু নাগরিকের সুষ্ঠু জীবনযাপন। সংবিধানে সামাজিক ও আর্থিক ন্যায়ের কথা রাজনৈতিক ন্যায়ের আগে বলা আছে।
ওই অর্থ সদ্ব্যবহারের আর একটা উপায় ভাবা যায় কি? আরও অনেক মস্ত একটা প্রকল্প সরকার হাতে নিয়েছে— এক নতুন শিক্ষানীতি। তার সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন, তিন বছর বয়স থেকে সব শিশুকে প্রাক্প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা, ও সেই উদ্দেশ্যে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে ঢেলে সাজানো। এ জন্য দেশ জুড়ে কেন্দ্রগুলির প্রচুর সংস্কার করতে হবে, ঘর তুলতে হবে।
দুর্দিনে সেই টাকা কোথায় জুটবে? দেশে অঙ্গনওয়াড়ির সংখ্যা প্রায় পৌনে চোদ্দো লাখ। ২০,০০০ কোটি টাকা তাদের মধ্যে ভাগ হলে গড়ে মিলবে দেড় লাখ মতো; ৬০,০০০ কোটি হলে সাড়ে চার লাখ। যোগ করুন একশো দিনের প্রকল্প থেকে মজুরির পুরো খরচ (অতএব দেশ জুড়ে কর্মসংস্থানের নিবিড় সুযোগ), মায় কিছু আনুষঙ্গিক রসদ। আর যোগ করুন শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ খাতে সরাসরি বরাদ্দ। মোট অঙ্ক থেকে যে অঙ্গনওয়াড়িগুলি ভাড়াবাড়িতে চলে তাদের বাড়ি নির্মাণের, বাকিদেরও রীতিমতো ভোল পাল্টাবার ব্যবস্থা করা যায়। সঙ্গে সরকারি খরচ বাড়াবার অর্থনৈতিক তাগিদ ষোলো আনা পূরণ হবে, জোয়ার আসবে ছোট বড় নানা শিল্পে— সেন্ট্রাল ভিস্টার চেয়ে ঢের বেশি।
স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষের শেষে, অর্থাৎ মার্চ ২০২৩-এর মধ্যে ভারতের প্রতিটি শিশুকে আমরা উপহার দিতে পারি শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সুরক্ষার একটা সুষ্ঠু আশ্রয়স্থল। ওই শুভলগ্ন পালনে এর চেয়ে ভাল উপায় হতে পারে কি? আসুন, আমরা সকলে সে জন্য সচেষ্ট হই।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়