পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন এ বার, তার মধ্যে দুটি রাজ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ ভোটযুদ্ধে নামছে আগামী কাল। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট এমন একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা করল, যার চোটে আগামী নির্বাচনের খোলনলচে প্রায় পাল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সম্প্রতি অভিরাম সিংহ বনাম সি ডি কোমাচেন মামলায় ৪-৩ গরিষ্ঠতায় এমন এক রায় পাওয়া গেল সর্বোচ্চ আদালতের কাছ থেকে, যাতে ১২৩(৩) ধারার জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের (রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অ্যাক্ট) ব্যাখ্যা আগের থেকে অনেকখানি বদলে গেল। বলা হল, নির্বাচনের সময়ে ধর্ম, জাতপাত বা অন্য কোনও রকম সম্প্রদায়-পরিচিতির উপর ভিত্তি করে প্রচার করা এখন থেকে সংবিধানবিরুদ্ধ হিসেবে গণ্য হবে।
৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ-হল রায়টি। যে বিচারকরা ছিলেন রায়ের পক্ষে, তাঁদের মতে, কেবল ভোটের প্রার্থীর ধর্ম বা জাত বিষয়েই এই নিষেধাজ্ঞা নয়, সঙ্গে সঙ্গে ভোটার সমাজের কাছেও এই মর্মে কোনও আবেদন করা নিষিদ্ধ ১২৩(৩) ধারা-মতে। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর বললেন, ধর্ম, জাতি, জাত, গোষ্ঠী বা ভাষার ভিত্তিতে আবেদন এখন থেকে একেবারেই পরিহারযোগ্য; যদি এমন কোনও ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ যদি প্রার্থীর ধর্ম কিংবা ভোটের এজেন্ট-এর ধর্ম, কিংবা বিরোধী প্রার্থীর ধর্ম, কিংবা ভোটারের ধর্ম, এর মধ্যে যে কোনও একটি বিষয়ে কোনও আপিল হয়, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন বাতিল ঘোষিত হতে পারে। ব্যাপারটা পরিষ্কার। যাতে কেবল প্রার্থীর ধর্মবিষয়ক আলোচনাই না বোঝানো হয়, তার জন্যই এতটা স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হল।
এখন কথা হল, যতই সুবুদ্ধিপ্রসূত হোক এই রায়, অত্যন্ত জরুরি কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ৪-৩ রায়ের বিপক্ষে যে বিচারকরা ছিলেন, তাঁরা প্রশ্নগুলি তুলেছেন। বিচারক ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বক্তব্য বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। রাজনীতি-বিশেষজ্ঞ প্রতাপভানু মেটা চন্দ্রচূড়ের এই বক্তব্যকে ভারতীয় আইনের ইতিহাসে একটি ‘ব্রিলিয়ান্ট’ মুহূর্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ১২৩(৩) নম্বর ধারা অনুযায়ী ধর্ম বা জাতের ভিত্তিতে কোনও প্রার্থীকে ভোট দেওয়া বা না-দেওয়া নিষিদ্ধ, সেটা তিনি স্বীকার করেন, কিন্তু এই প্রসঙ্গে তাঁর একটা পাল্টা বক্তব্যও আছে। ভারতের সংবিধান কিন্তু দেশের ‘পাবলিক স্পেস’ বা নাগরিক পরিসরে ধর্ম, জাতি, জাত, গোষ্ঠী বা ভাষা সংক্রান্ত সত্তাকে নিষিদ্ধ করার কথা বলে না। সুতরাং, তাঁর মতে, কোনও ভাবেই ১২৩(৩) নম্বর ধারার উদ্দেশ্য এটা হতে পারে না যে, ‘আমাদের দেশের যে নাগরিকরা প্রতি দিন এই সব সত্তার ভিত্তিতে অবিচার, অত্যাচার কিংবা বৈষম্যের স্বীকার হয়ে চলেছেন, দেশের নির্বাচনী পরিসরে ঢুকতে গেলে তাঁদের সেই প্রত্যক্ষ বাস্তবটাকে বাদ রেখে আসতে হবে।’
একটা বিষয়ে অবশ্য রায়ের পক্ষ বা বিপক্ষ দুই দলই বিশেষ জোর দেননি। এই ১২৩(৩) ধারার অধীনে নির্বাচনী প্রচারে কী ও কতটা বলা সংগত, বিশেষত ধর্ম প্রসঙ্গে, এই নিয়ে আমাদের বিচারবিভাগ বহু কাল ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে। ১২৩(৩) ধারা বিষয়ে আইনের পরিসরটি বিচার করা এ ক্ষেত্রে খুব জরুরি। এবং সেটা করলে বোঝা যাবে কতখানি অসামঞ্জস্য এখানে থেকে গিয়েছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে আদালত যদিও ১২৩(৩) ধারাটিকে তুলে ধরেছে, যখনই উল্টো দিক থেকে গুরুতর প্রতিবাদ এসেছে কিংবা যখনই বাক্স্বাধীনতার অধিকার ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে কিন্তু দেখা গিয়েছে আদালতের অতিসাবধানী অবস্থান। বিচারবিভাগের সমস্যাটা ঠিক কেমন থেকেছে এত কাল ধরে, সেটা দুটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে বোঝানো যেতে পারে। ঘটনা দুটির মধ্যে দু’দশকের দূরত্ব। দুটিই অকালি দলের সঙ্গে যুক্ত।
প্রথম ঘটনাটি কুলতার সিংহ বনাম মুখতিয়ার সিংহ (১৯৬৫) মামলা। অকালি দলের প্রার্থী তাঁর ভোটারদের সামনে দাঁড়িয়ে শিখ ধর্মের কথা বলে ভোট চাইছেন— এই ঘটনা সংবিধানসম্মত কি না, সেটা স্থির করতে আদালতকে রীতিমত বিপাকে পড়তে হয়েছিল। লক্ষণীয়, শেষ অবধি আদালত মেনে নিয়েছিল যে অকালি দলের মতো রাজনৈতিক পার্টি যেহেতু ধর্ম ও জাতিগত বিশিষ্টতার ভিত্তিতেই গঠিত, তার মধ্যে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের একটা বিরুদ্ধতা প্রথম থেকেই আছে। তার উপর নির্বাচনের সময় যে উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়, তার প্রতিও আদালত খানিকটা সহমর্মিতা না দেখিয়ে পারেনি। বলা হয়েছিল, ‘নির্বাচনী প্রচারে যখন দুই বিরুদ্ধ পক্ষের প্রার্থীরা পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে, তার মধ্যে যে সাধারণ ভাবেই একটা সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাদী (‘পার্টিজান’) ভাব থাকবে, সেটা অস্বীকার করা যায় না।’ এই যুক্তিতে অকালি দলের প্রার্থীকে নির্দোষ ঘোষণা করা হল, বলা হল, তিনি নির্বাচকমণ্ডলীর সামনে শিখ ‘পন্থ’-এর জয় চেয়ে ভোট প্রার্থনা করে আইন লঙ্ঘন করেননি।
এ বার আর একটি মামলার উদাহরণ। হরচরণ সিংহ বনাম সজ্জন সিংহ (১৯৮৫) মামলাতেও একই ভাবে অকালি দলের প্রার্থীকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু আদালতের রায় ছিল ঠিক উল্টো। বলা হয়েছিল, প্রার্থী যখন বলেছেন তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া মানে শিখ ধর্মের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া, তিনি অন্যায় করেছেন, অসাংবিধানিক কাজ করেছেন। আগেকার কুলতার সিংহ মামলার রায়ের (যেখানে বলা হয়েছিল নির্বাচনী প্রচারে কোনও ভাবে ধর্মসংক্রান্ত কথাবার্তা উঠে আসতেও পারে) উল্টো দিকে গিয়ে বুখারি বনাম মেহরা মামলাতেও বলা হল, ধর্ম নামক ‘অযৌক্তিক’ বিষয় নিয়ে কোনও নির্বাচনী আলোচনা স্বীকৃতিযোগ্য নয়।
১২৩(৩) ধারা বিষয়ে এখনও পর্যন্ত সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘হিন্দুত্ব’ রায়-সংক্রান্ত মামলাগুলি। এদের প্রতিটিই ১২৩(৩) ধারা নিয়ে। তাই একসঙ্গে এদের হিন্দুত্ব রায়-সংক্রান্ত বলার কারণটা সহজেই বোধগম্য। এর মধ্যে সবচেয়ে শোনা যায় প্রভু বনাম কুন্তে নামক মামলাটির কথা, যেখানে আদালত সেই বিতর্কিত রায়টি দেয় যে, নির্বাচনের সময় হিন্দুত্ব নিয়ে কথা বলা যেতেই পারে, কেননা হিন্দুত্ব অর্থাৎ হিন্দুধর্ম তো কেবল ধর্ম নয়, একটা সার্বিক জীবনচর্যাও (‘ওয়ে অব লাইফ’) বটে! আমাদের এই সাম্প্রতিকতম রায়টিতে সর্বোচ্চ আদালত হিন্দুত্বের নৈতিকতা বিষয়ে কোনও কথাই বলেনি, কিন্তু সে দিন হিন্দুত্ব রায়-সংক্রান্ত মামলাগুলিতে ঠিক উল্টোটা হয়েছিল, হিন্দুত্বের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব নিয়ে ১২৩(৩) ধারা সম্পর্কে সেখানে নানা রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল। যেমন, জোশী বনাম পাটিল মামলায় বলা হয়েছিল, ‘প্রথম হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি হবে মহারাষ্ট্র রাজ্যে’— এই ঘোষণার মধ্যে ‘মোটেই ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া হয়নি, কেবল তেমন একটা আশা প্রকাশিত হয়েছে মাত্র।’ বিপরীতে, মহাধিক বনাম নায়েক মামলায় আদালত কিন্তু ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির একটা প্রেক্ষিত-আলোচনা দাবি করে। এবং সিদ্ধান্ত করে যে, অভিযু্ক্ত শিব সেনা প্রার্থী তাঁর প্রচারে যে ভাবে হিন্দুত্বের ব্যবহার করেছেন সেটা সমর্থন করা যায় না—কোনও হিন্দু মন্দিরের সামনে গিয়ে হিন্দু ভক্তদের সামনে হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া একেবারেই অবৈধ।
অর্থাৎ সংবিধানের এই ১২৩(৩) ধারা এবং স্বাধীন ভারতে তার ব্যবহারের ইতিহাস অনেক আঁকাবাঁকা পথে ঘুরে এসেছে। সাম্প্রতিক অভিরাম সিংহ মামলাটিতে এই ইতিহাসের প্রতিফলন ঘটেনি। আগেকার আইন আর তার প্রসঙ্গভিত্তিক ব্যাখ্যার একটা ছায়া এতে থাকতে পারত। কাকে বলে ধর্মভিত্তিক আবেদন, কিংবা নির্বাচনী প্রচারে কী ধরনের কথাবার্তা হলে ১২৩(৩) ধারা মানা-না-মানার প্রশ্ন উঠবে, সেগুলো স্পষ্ট করা হয়নি। তা ছাড়াও একটা কথা। ১২৩(৩) ধারা অন্ধ ভাবে প্রয়োগ করার একটা ব্যবহারিক সমস্যা আছে। নির্বাচনে ধর্ম ও জাত-সংক্রান্ত প্রতীক গোটা দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে। আর, জনপ্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের পরই প্রয়োগ করার কথা, তাই এর ফলে নির্বাচনে জনতার রায়কে পাল্টে দিতে হতে পারে। সেটা একটা বড় সমস্যা।
এই সব কারণে, সুপ্রিম কোর্টের এ বারের রায় প্রথম বিচারে যতই যথার্থ মনে হোক, নির্বাচনে ধর্ম বা জাত-ভিত্তিক আবেদন বাস্তবে সত্যিই নিষিদ্ধ করে দেওয়া যায় কি না, সেটা আগামী দিনেও একটা সংকটময় প্রশ্ন হয়ে থাকতে চলেছে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর-এ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ-এর সঙ্গে যুক্ত