প্রতীকী ছবি।
ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে যান নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক কর্মী বহাল হইলেন। স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে কিনা নিয়োগটি যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনিবার স্বাভাবিক স্পৃহা হইতে নহে, জনরোষের চাপে। কিছু দিন পূর্বেই ওই স্থানে বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারাইয়াছে পঞ্চমবর্ষীয় এক ছাত্রী। বাস হইতে নামিয়া মায়ের সঙ্গে সে স্কুলে প্রবেশ করিতেছিল। আচমকা গতি বৃদ্ধি করিয়া বাসটি ছাত্রীর প্রাণ লয়। অতঃপর পথনিরাপত্তার দাবিতে অভিভাবকের বিক্ষোভ, রাস্তা অবরোধ এবং থানায় স্মারকলিপির পেশের পরিচিত পরম্পরাটির পর প্রশাসনের টনক নড়িয়াছে। একটি শিশু এমন মর্মান্তিক ঘটনায় প্রাণ না হারাইলে হয়তো নাগেরবাজারের মতো ব্যস্ত এবং স্কুলবহুল এলাকায় যান চলাচলে কড়া নজরদারির প্রয়োজনটি উপেক্ষিতই থাকিত।
এই বিলম্ব কেন? কলিকাতার নাগরিক তাহা জানেন। পথসুরক্ষায় নজর দিবার ক্ষেত্রে রাজ্য প্রশাসনের দীর্ঘ গাফিলতি তাঁহাদের সুপরিচিত। একে যানবাহনের সংখ্যায় অতিবৃদ্ধিতে শহর কলিকাতার নাভিশ্বাস উঠিতেছে। তদুপরি, এই বাড়তি চাপ সামলাইবার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল, তাহাতে বিস্তর ফাঁক রহিয়াছে। ফুটপাতগুলি হকারের দখলে, পথচারীর ভিড় রাস্তায় নামিয়াছে। এবং, প্রধানত কমিশন প্রথার কারণে, বেসরকারি বাসের রেষারেষি ও বেপরোয়া গতি কমিবারও লক্ষণ নাই। যত্রতত্র বাস থামাইয়া যাত্রী তুলিবার এবং নামাইবার প্রবণতাও অপরিবর্তিত। সম্মিলিত ফল, অহরহ দুর্ঘটনা। শুধুমাত্র কিছু পোস্টার এবং পথনিরাপত্তা সপ্তাহ সম্বল করিয়া দুর্ঘটনায় রাশ টানা সম্ভব নহে। দরকার কড়া প্রশাসন এবং সচেতন নাগরিক। কলিকাতার দুর্ভাগ্য, কোনওটিই তাহার নাই। প্রশাসনের কড়া হইবার নমুনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জরিমানা আদায়েই সীমাবদ্ধ। জরিমানা গনিয়া দিবার পর ফের বেপরোয়া হইতে বাধা নাই। অন্য দিকে, প্রচার সত্ত্বেও নাগরিক বেহুঁশ। কানে মোবাইল লইয়া রাস্তা পারাপার, হেলমেট ব্যবহারে অনীহা, সিগনাল না-মানা— কার্যত ‘আত্মহনন’-এর উপযোগী সমস্ত কাজই সে নিয়মিত করিয়া থাকে। শুধুমাত্র আইন করিয়া প্রাণ বাঁচানো কঠিন বইকি!
অথচ, প্রশাসন এবং নাগরিকের এক সুষ্ঠু সমন্বয় এই ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকাংশে কমাইতে পারিত। যে কোনও সভ্য সমাজে পথ-আইনকে এক বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। আইন মানাইবার জন্য সেখানে চপেটাঘাতের প্রয়োজন হয় না। নিজ নিরাপত্তার খাতিরেই যে ট্রাফিক আইন মানিয়া চলা প্রয়োজন, সেই বোধটুকু ‘সভ্য’ মানুষের আজন্মলালিত। বিশেষত, স্কুল এবং হাসপাতালের সামনের রাস্তায় যান চলাচলে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা হয়। স্কুলের সময়টুকুতে গতির ঊর্ধ্বসীমা বাঁধিয়া দেওয়া থাকে। শুধু তাহা নহে, স্কুল এবং হাসপাতাল চত্বরের শান্তি অ-বিঘ্নিত রাখিতে সামনের রাস্তায় যে কোনও অপ্রয়োজনীয় শব্দও নিষিদ্ধ। কিন্তু এই পোড়া দেশে তাহা হইবার নহে। একটা বড় কারণ শিক্ষার অভাব। পুঁথিগত শিক্ষা নহে, মানবিক শিক্ষা। যে শিক্ষা বলে, সমাজে বাস করিবার জন্য সামাজিক শৃঙ্খলা পালন করা প্রয়োজন। বিশেষত শিশু, অসুস্থ এবং বয়স্কদের জন্য কিঞ্চিৎ বাড়তি যত্নের প্রয়োজন। এই শিক্ষা অন্তর হইতে আসিবার কথা। প্রশাসনেরও, নাগরিকেরও। যত দিন না আসিবে, দেশের একটি পথও নিরাপদ নহে।