নিউজ়িল্যান্ডে হাই স্কুলের ছাত্রদের জুলিয়াস সিজ়ারের উদ্ধৃতি "In war, events of importance are the result of trivial causes"-এর উপর ভিত্তি করিয়া একটি রচনা লিখিতে দেওয়া হইয়াছিল। বহু ছাত্র দাবি করিল, তাহারা ‘ট্রিভিয়াল’ শব্দটির অর্থ জানে না। প্রায় আড়াই হাজার মানুষ একটি অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করিয়াছেন, প্রশ্নে এমন ‘অপরিচিত’ শব্দ ব্যবহার করিবার প্রতিবাদে। পরীক্ষকরা বলিলেন, একটি ত্রয়োদশবর্ষীয় ছাত্রের জ্ঞাত শব্দভাণ্ডারের মধ্যে শব্দটি থাকিবে বলিয়াই তাঁহারা অনুমান করিয়াছিলেন। যদি ছাত্রেরা উদ্ধৃতিটি ব্যাখ্যা বা (অ)সমর্থন করিবার জন্য নিজেদের ভাবনাচিন্তা প্রয়োগ করিয়া কিছু লিখিয়া থাকে, তাহাদের যুক্তি ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই নম্বর দেওয়া হইবে, ‘ট্রিভিয়াল’ শব্দটির অর্থ যথার্থ বুঝিয়াছে কি না, তাহার উপরে মূল্যায়ন নির্ভর করিবে না। আবার চিন-এ, একটি গণিত পরীক্ষায় প্রশ্ন লইয়া আলোড়ন সৃষ্টি হইয়াছে। একাদশবর্ষীয়দের জন্য প্রদত্ত প্রশ্নটি হইল, ‘‘যদি একটি জাহাজে ২৬টি ভেড়া ও ১০টি ছাগল থাকে, তবে জাহাজের ক্যাপ্টেনের বয়স কত?’’ চিনের সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রশ্নটি ও তৎসহ কিছু ছাত্রের উত্তর ‘ভাইরাল’ বইয়াছে গত সপ্তাহে। কর্তৃপক্ষ বলিয়াছেন, প্রশ্নটিতে কোনও ভুল নাই, ওইটি করিবার উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের ‘বিচার-চেতনা’র মূল্যায়ন। তাহা যে একেবারেই হয় নাই, তাহা নহে। এক ছাত্র লিখিয়াছে, ‘‘ক্যাপ্টেনের বয়স ন্যূনতম ১৮, কারণ জাহাজ চালাইবার জন্য তাঁহাকে প্রাপ্তবয়স্ক হইতেই হইবে।’’ অন্য এক জন লিখিয়াছে, ‘‘ক্যাপ্টেনের বয়স ৩৬, কারণ জন্তুদের সংখ্যা (২৬+১০) তিনি নিজের বয়সের সমান করিতে চাহিয়াছেন।’’ সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যঙ্গের অভাব হয় নাই। কেহ লিখিয়াছে, ‘‘যদি একটি বিদ্যালয়ে থাকে ২৬ জন শিক্ষক, যাঁহাদের মধ্যে ১০ জন কোনও ভাবনাচিন্তা করেন না, তাহা হইলে প্রিন্সিপালের বয়স কত?’’ কর্তৃপক্ষ বলিয়াছেন, প্রশ্নটির উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন ভাবে চিন্তা করিবার অভ্যাস উস্কাইয়া দেওয়া। চিনে গণিত (ও অন্যান্য বিষয়েরও) শিক্ষা মূলত দেওয়া হয় মুখস্থ ও পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে। বহু সমালোচক বলেন, ইহা নিজস্ব চিন্তার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে। ছাত্রদের ‘সীমানা অতিক্রম করিয়া’ ভাবিবার ক্ষমতা অর্থাৎ ‘আউট অব দ্য বক্স’ চিম্তাকে প্রণোদিত করিবার জন্যই এই প্রশ্ন।
আমাদের মুখস্থ বিদ্যার দেশে, যেখানে কেবল যাহা সকলেই বলে, তাহাই পুনরায় বলিবার প্রতি জোর দেওয়া হইয়া থাকে, নূতন চিন্তা নূতন ব্যাখ্যার প্রতি সার্বিক অনীহার স্রোত সগর্জন বহমান, সেইখানে যদি পরীক্ষায় এমন সব প্রশ্ন আসিত, যাহার উত্তর দিতে হইলে অমুক পৃষ্ঠা হইতে তমুক পৃষ্ঠা পর্যন্ত মুখস্থ করিবার কোনও প্রয়োজন নাই, পরীক্ষাকেন্দ্রে বসিয়া নিজের মাথাটি খাটাইয়া কল্পনা ও যুক্তিবিচার প্রয়োগ করিবার প্রয়োজন, তাহা হইলে হয়তো ছাত্রছাত্রীদের মস্তিষ্ক অধিক বিকশিত হইত। গণিতের আপাত উদ্ভট প্রশ্নেরও জবাব তো অনেকে প্রস্তুত করিয়াছে। অর্থাৎ, বাধ্য হইলে লোকে মস্তিষ্কের আলস্য কাটাইয়া, তাহাকে বহু দূর চালাইতে পারে, উদ্ভটতার মধ্যে কোনও যুক্তিক্রম লুক্কায়িত রহিয়াছে ভাবিয়া আকাশ-পাতাল হাতড়াইতে পারে। আর, তাহাই কি শিক্ষার উদ্দেশ্য নহে? চিনের গণিতের প্রশ্নটি যতই আচাভুয়া হউক, নিউজ়িল্যান্ডের প্রশ্নটিতে অপরিচিত শব্দ থাকুক, ‘যেমন করিয়া হউক ইহার সমাধান করিব’ ভাবিয়া ছাত্রেরা যে নিজস্ব যুক্তি দিবার চেষ্টা করিয়াছে, বা অপরিচিত শব্দটির অর্থ অবশিষ্ট বাক্যটির প্রেক্ষিতে ভাবিয়া বাহির করিতে চাহিয়াছে, তাহা কি চমৎকার মগজব্যায়াম নহে? প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি, যদি এই প্রকারের প্রশ্নের অন্তত একটি বিভাগ থাকে প্রতিটি বিষয়ে, তাহা হইলে ছাত্রেরা মুখস্থের ভার হইতে কিছু পরিমাণে রক্ষা পায়, আর পরীক্ষার ভীতিপ্রদ নখদন্তের মধ্যে কিঞ্চিৎ কৌতুক ও উত্তেজনা আবিষ্কার করিতে পারে। স্থিতিপ্রীতি যাহাদের রহিয়াছে, তাহারা মহা শোরগোল করিবে, তাহারা নিরাপদ ও নিবিড় অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই জগৎ জয় করিতে চাহে, কিন্তু কিছু নবীন ও কাঁচা এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে উৎসাহী হইয়া উঠিবে, শিক্ষাপদ্ধতিকে এই দেশে যেমন নিংড়াইয়া নীরসতম করিয়া আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়িয়াছি, তাহাতে একটি সতেজ নূতন বায়ু উপস্থিত হইবে। কাহিনির তোতা আকাশে উড্ডীন হইবে, জন্তুবাহী নৌকাটির ক্যাপ্টেনের বয়সজিজ্ঞাসার রহস্যটি ‘ট্রিভিয়াল’ বা তুচ্ছ মনে হইবে না!