প্রতিবাদী অনুষ্ঠানকে কৃত্রিম বলে মনে হচ্ছে

এই সব অনুষ্ঠান কি ভারতীয় সমাজকে আরও মেরুকরণের পথে ঠেলে দিচ্ছে না? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষালএই সব অনুষ্ঠান কি ভারতীয় সমাজকে আরও মেরুকরণের পথে ঠেলে দিচ্ছে না? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share:

ছবি: সুদীপ আচার্য।

নানা জাতির সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে আমাদের হিন্দু জাতি। প্রাচীনকালে অনুলোম-প্রতিলোম বিয়ের মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছিল। তার পর তুর্কি হানার পরে এল জাতিভেদের কড়াকড়ি। হিন্দু সমাজের মধ্যেও নানা জাতিস্বাতন্ত্র্য গড়ে উঠল। উচ্চ শ্রেণির হিন্দু নিজেদের আর্যসন্তান হিসাবে দাবি করে। ভাবটা এমন, আমরা বিদেশ থেকে এসে অনার্যদের পরাস্ত করে অভিজাত হিন্দু হলাম। কুৎসিত দর্শন, অসভ্য, বর্বর অনার্য মানুষ তাদেরকে দাবিয়ে বেদ-সংহিতা পড়ে রচিত হল পুরাণ। আর্যদের রাজবংশ ইতিকথা নিয়ে তৈরি হল রামায়ণ-মহাভারত আর পুরাণ।

Advertisement

কোনও এক মুসলমান বন্ধু তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহসভার সভাপতি নিমর্লচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঁচটি প্রশ্ন পাঠিয়ে জবাব জানতে চেয়েছিলেন। সেই প্রশ্ন পাঁচটি নির্মলবাবু সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঠান। প্রথম প্রশ্নটি ছিল, হিন্দুত্ব কাকে বলে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, হিন্দুত্ব আর হিন্দু ধর্ম কি এক? তৃতীয় প্রশ্ন, হিন্দু ধর্মের সংজ্ঞা কোন ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে? চতুর্থ প্রশ্ন, যে ব্যক্তি কোরাণ-বাইবেল অথবা বৌদ্ধ পঞ্চশীলে বিশ্বাস করে তিনি কি হিন্দু বলে গৃহীত হতে পারেন? পঞ্চম প্রশ্ন, হিন্দু হলে তাঁর গুণ বা লক্ষ্মণ কী কী হবে বা কী কী বিশ্বাস বা আচরণ থাকলে তিনি হিন্দু বলে চিহ্নিত হবেন না? সুনীতিবাবু যা বলেছিলেন, তাঁর নির্যাস হল অন্য কোনও ধর্মমতকে বাদ দিয়ে অথবা অস্বীকার করে একটি মাত্র মতামত নিয়ে হিন্দুত্ব গঠিত নয়। রিলিজিয়ন এই ইংরেজি শব্দের মূল লাতিন ভাষা অনুসারে, মৌলিক অর্থ হল— চিন্তা বা মনন এই অর্থ ধরলে হিন্দুত্ব হল হিন্দুর বিশিষ্ট চিন্তাধারা। এবং সেটাই হিন্দু ধর্ম। যে ব্যক্তি কোরাণ-বাইবেলে বিশ্বাস করেন তিনিও হিন্দু বলে গৃহীত হতে পারেন। শুধু সুনীতিবাবু একটি শর্ত দিয়েছিলেন যে, সেই ব্যক্তি যেন হিন্দু সমাজের মধ্যে বাস করে যেটি সামাজিক সদাচার সে সবের বিরোধী না হন। এবং নিজের বিশেষ ধর্মসম্বন্ধীয় ভাবনাকে অপরকে দীক্ষিত করতে বাধ্য না করেন।

আজ যখন গোটা দেশ জুড়ে গো-মাংস ভক্ষণের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তখন এটুকু বোধহয় বলার সময় এসেছে যে ধর্ম নিয়ে ভোটের রাজনীতি হল সব সমস্যার প্রধান কারণ। কবি নজরুল এক বার বলেছিলেন, হিন্দু ও মুসলমান দু’টি ধর্মেই প্রধান সমস্যাটি কিন্তু ধর্মের মধ্যে লুকিয়ে নেই। রয়েছে দাড়ি ও টিকির মধ্যে। কাজি নজরুল লিখছেন, ‘‘হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়। কিন্তু তাদের টিকিত্ব, দাড়িত্ব অসহ্য। কেননা, ওই দু’টি মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়। ওটা হয়তো পান্ডিত্য। তেমনই দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলোচুলি। আজ যে মারামারিটা বেধেছে সেটাও এই পন্ডিত-মোল্লায় মারামারি, হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়...আলো নিয়ে কখনও ঝগড়া করে না মানুষে। কিন্তু গরু-ছাগল নিয়ে করে।’’(রুদ্রমঙ্গল রচনাবলি প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০৭)। রবীন্দ্রনাথও লিখেছিলেন, মৎস্যাশী মানুষের সঙ্গে নিরামিশাষী মানুষের ঝগড়া বেধে যায় কারণ এক জন আর এক জনের পরিবেশগত অভ্যাসকে গ্রহণ করতে পারে না। বৈদিক যুগে মানুষ গরু খেতেন। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী সে দিন একটি টিভি চ্যানেলে বলছিলেন, বিশেষ অতিথি এলে শুধু গরুভক্ষণই করানো হত না, স্বাস্থ্যবান গরুর কাঁধটি সেই অতিথিকে খেতে দেওয়া হত। কিন্তু প্রশ্ন হল, গো-মাংস ভক্ষণ বন্ধ করা অনুচিত বলে জবরদস্তি রাস্তায়-রাস্তায় গরুর মাংস খাওয়ার অনুষ্ঠান পালন করতে হবে, যেমন কলকাতায় সম্প্রতি করলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য ও কবি সুবোধ সরকার। সেটাও আমার খুব কৃত্রিম মনে হয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য তাঁরা মহম্মদ সেলিমকে সঙ্গে নিয়ে শুয়োর ভক্ষণের একটি অনুষ্ঠান করবেন কি? এই প্রশ্নটি তুলেছেন তসলিমা নাসরিন। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, এই সব অনুষ্ঠান কি ভারতীয় সমাজকে আরও মেরুকরণের পথে ঠেলে দিচ্ছে না?

Advertisement

স্বাধীনতার পর ভারতে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষের সংখ্যা বছরের পর বছর বেড়েছে। ১৯৬০ সালে যেখানে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছিল ৬০টি, পরের বছর তা বেড়ে হয় ৯২। আর ’৬৬-তে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২২০। ’৬৮-’৬৯-এ ৩৯৫টি। ’৭০-’৭১-এ হয় ৮৪২টি। কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীরা বারংবার বলেছেন, এই বৃদ্ধির পিছনে প্রধান কারণ হল, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ। এর জন্য বীর সাভারকরকেও তাঁরা দায়ী করেন। ১৯৫৩ সালে একটি আধা সামরিক হিন্দু যুব সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল। নাম দেওয়া হয়েছিল হিন্দু রাষ্ট্র দল। প্রত্যক্ষ ভাবে সাভারকর এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গাঁধী সাভারকরের তত্ত্বের সমালোচক ছিলেন। গাঁধী বলেছিলেন, হিন্দু ও মুসলমান আসলে একটিই জাতি। তাই হিন্দু রাজ নয়, চাই স্বরাজ। এটাই ছিল গাঁধীর স্লোগান। ইয়ঙ্গ ইন্ডিয়া পত্রিকায় এ কথা গাঁধী লিখেছিলেন। ১৯৩৯ সালে হিন্দু মহাসভার নাগপুর অধিবেশনে সাভারকর গাঁধীর এই তত্ত্বকে খারিজ করে আওয়াজ তোলেন, হিন্দু জাতীয় ফ্রন্ট গঠন করতে হবে।

হাঁস আগে না কি হাঁসের ডিম আগে? হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার উৎস সন্ধান নিয়ে কয়েক দশক ধরে বিতর্ক চলছে। যা হয়তো আরও কয়েক দশক ধরে চলবে। সুমিত সরকারের মতো ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, ভারতের জাতীয় আন্দোলনে উগ্র হিন্দু জাত্যাভিমান মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল জনক। আবার উল্টো দিকে মুসলমানদের নিয়ে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি-র মতো দলের উত্থানের বড় কারণ। রাজনৈতিক দল তাদের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। আমাদের বোধহয় রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে এ কথা ভাবার সময় এসেছে, যে-ধর্ম মানুষকে বিভাজিত করে, মিলিত করে না সেটি ‘ধর্মমোহ’ হতে পারে, ধর্ম নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement