Editorial News

বিপ্লব চুপচাপও আসে

চার শতাব্দী ধরে চলতে থাকা এক জীর্ণ, পরিত্যাজ্য প্রথার বিরুদ্ধে নীরবে, অলক্ষ্যে যে বারুদের স্তূপ জমা হয়েছে কঞ্জরভাট সমাজে, সেই স্তূপ লক্ষ্য করে স্ফূলিঙ্গপ্রপাত ঘটালেন বিবেক-ঐশ্বর্য।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৮ ০০:৫৫
Share:

লড়াই: ‘সতীত্বের পরীক্ষা’ না দিয়েই বাউন্সারদের নিয়ে এ ভাবেই বিয়ে সারলেন বিবেক-ঐশ্বর্য।

চাদরটা সাদা বটে। কিন্তু প্রথাটা ততটাই কর্দমাক্ত। আদিম বা মধ্যযুগীয় কোনও বাষ্প যেন এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে একটা গোটা জনগোষ্ঠীকে। যত প্রভাবশালী‌ই হন না কেন, গোটা সমাজের পক্ষে লজ্জাজনক এবং নারীর পক্ষে চূড়ান্ত অবমাননাকর প্রথাটা ভেঙে দেওয়ার সাহস দেখাননি কেউ।

Advertisement

কিন্তু বিপ্লব সব সময় বজ্রনির্ঘোষ সঙ্গী করে আসে না। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গই বিপ্লবের পথ দেখিয়ে দেয় অনেক সময়। মহারাষ্ট্রের বিবেক ও ঐশ্বর্য চকমকি পাথর হিসেবে কাজ করলেন। একটা স্ফুলিঙ্গ উৎপাদন করলেন।

চার শতাব্দী ধরে চলতে থাকা এক জীর্ণ, পরিত্যাজ্য প্রথার বিরুদ্ধে নীরবে, অলক্ষ্যে যে বারুদের স্তূপ জমা হয়েছে কঞ্জরভাট সমাজে, সেই স্তূপ লক্ষ্য করে স্ফুলিঙ্গপ্রপাত ঘটালেন বিবেক-ঐশ্বর্য। আগুনটা দাউদাউ করে উঠবে, নাকি বারুদের স্তূপ পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই নিভে আসবে, সে এখনই বলা যায় না। কিন্তু সিন্ধুপ্রমাণ জলধি এক দিনে যে সমন্বিত হয় না, তা প্রত্যেকেরই জানা। অতএব বিন্দুতে বিন্দুতে এগনোর চেষ্টা করাই শ্রেয়।

Advertisement

একটা মানুষের বিচারের মাপকাঠি একটা সতীচ্ছদ! বিয়ের রাতে বধূকে প্রমাণ দিতে হবে যে তাঁর যোনি অক্ষত। কী ভাবে দিতে হবে প্রমাণ? সাদা চাদরের উপরে স্বামীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করে। কাদের কাছে এবং কী ভাবে প্রমাণ দিতে হবে? সঙ্গমের আগে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় মুখোমুখি হতে হবে সম্প্রদায়ের কোনও মহিলার। আর সঙ্গমের পরের সকালে দাগ লাগা সাদা চাদর দেখাতে হবে রাতভর দরজার বাইরে অপেক্ষায় থাকা মোড়ল-মাতব্বরদের।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

বিয়ের আগে অন্য কারও সঙ্গে যৌন সঙ্গম করেননি নারী— সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতেই সতীত্ব পরীক্ষার এই প্রথা। পরীক্ষায় পাশ না করলে বিয়ে অবৈধ। অর্থাত্ সঙ্গমের পরের সকালে চাদর দেখে যদি মোড়ল-মাতব্বরদের মনে হয় যে, নববধূর সতীচ্ছদ আগেই কখনও ছিন্ন হয়েছিল, তা হলে বিয়ে তো মান্যতা পেলই না, সর্বসমক্ষে নববধূর জন্য অপেক্ষায় রইল চরম লাঞ্ছনা।

স্বামী-স্ত্রী না চাইলেও পরীক্ষা হবেই। সামাজিক পঞ্চায়েত ফুলশয্যায় উঁকি দেবেই। এ আপত্তিকর এবং অপমানজনক প্রথার বিরুদ্ধে আত্মীয়-পরিজন-জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিলেন বিবেক। কুখ্যাত প্রথাটি বাদ দিয়েই বিয়ে সারলেন তিনি। পুলিশের উপস্থিতিতে এবং বাউন্সারদের ঘেরাটোপে থেকে বিয়েটা সারতে হল। বিয়ের পরের পরিস্থিতিটাও সম্ভবত বেশ অভূতপূর্ব হচ্ছে বিবেক-ঐশ্বর্যর জন্য। কিন্তু দৃষ্টান্ত এ ভাবেই স্থাপিত হয়। সমাজকে এ ভাবেই পথ দেখাতে হয়।

আরও পড়ুন: বিয়ের দিনে সাদা চাদরে ‘সতীত্বের পরীক্ষা’ দিতে হল না ঐশ্বর্যকে

বিয়ের আগে অন্য কারও সঙ্গে যৌন সঙ্গম হয়েছে কি না, তার পরীক্ষা শুধু নারীকে কেন দিতে হবে? পুরুষকে কেন নয়? সতীচ্ছদ অক্ষত থাকা বা না থাকা দিয়ে সত্যিই কি কিছু প্রমাণ হয়? দাম্পত্যের নিভৃততম পরিসরটিতে গোটা সমাজ বা গোটা পঞ্চায়েত উঁকি মারতে চাইবে কেন?

এমন অজস্র প্রশ্ন বছরের পর বছর ঘুরপাক খাচ্ছিল সাদা চাদরের তলায়। চাদরটাকে তবু ছুড়ে ফেলার সাহস হয়নি কারও, প্রশ্নগুলো অতএব প্রকাশ্যে আসতে পারেনি। বিবেক-ঐশ্বর্যরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী মনোবলের পরিচয় দিলেন অতএব। সাদা রঙের ‘কালো’ চাদরটা দাম্পত্যের বিছানা থেকে ছুড়ে ফেললেন। স্পষ্ট উচ্চারণে প্রশ্নগুলোকেও নিজের সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরলেন। দিন বদলের সূচনা সেখান থেকেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement