দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ক্রমেই সোনার পাথরবাটি। এ হল ‘৫৬ ইঞ্চি’র চতুর্থ কুমির ছানা।
প্রথম পর্ব: নোটবন্দি
সময়টা ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর। সন্ধ্যার সময়ে জানা গেল পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বাতিল হচ্ছে। কেন? কালো টাকা উদ্ধার এবং সেই সূত্রে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা। পাশাপাশি, ডিজিটাল, নগদহীন অর্থনীতির দিকে হাঁটা। ‘৫৬ ইঞ্চি’র ‘বলিষ্ঠ’, ‘দুঃসাহসিক’ পদক্ষেপে অনেকে ধন্য ধন্য করে উঠলেন। কিছু নাগরিক সন্দেহ প্রকাশ করলেন, বিরুদ্ধ যুক্তি দিলেন। তাঁদের ঠারেঠোরে দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করা হল। দেশপ্রমিক-দেশদ্রোহী আড়াআড়ি বিভাজন স্পষ্ট হল।
পরের দিন সকাল থেকে ব্যাঙ্ক ও এটিএম-এর সামনে লম্বা লাইন। ব্যাঙ্ক কর্মীদের দুর্বিষহ দিনযাপন। ঘন ঘন নির্দেশিকা বদল। সাধারণ নাগরিকদের চূড়ান্ত হয়রানি। কিছু মৃত্যুর কথাও শোনা গেল। ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলি, যাদের দৈনন্দিন ব্যবসা নগদ-নির্ভর তারা রুগ্ন হতে শুরু করল। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে অর্থনীতির অসংগঠিত ক্ষেত্রে ভয়াবহ কাঁপন ধরল।
তার পরে প্রায় তিন বছর ঘুরে গেল। কালো টাকা ফিরল না। উল্টো দিকে, কোটি কোটি টাকা ঋণখেলাপ করে ‘ঘনিষ্ঠ’ শিল্পপতিরা বিদেশ চলে গেলেন। কাশ্মীর উপত্যকায় একের পর এক সন্ত্রাসবাদী ঘটনা প্রমাণ দিল নোটবন্দি করে সন্ত্রাস নির্মূল করা যায়নি। আর পড়ে থাকে ডিজিটাল ও নগদহীন অর্থনীতির গল্প। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, অর্থনীতিতে নগদ লেনদেনের মাত্রা আগের তুলনায় কমেনি, উল্টে আরও বেড়েছে। কিন্তু তার পরেও
‘৫৬ ইঞ্চি’র দিকে সে ভাবে আঙুল উঠল না। এ হল ‘৫৬ ইঞ্চি’র প্রথম কুমির ছানা।
দ্বিতীয় পর্ব: জিএসটি রূপায়ণ
দেশব্যাপী পণ্য ও শ্রমের উপরে একই কর ব্যবস্থা। নিঃসন্দেহে কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্কে নতুন সমীকরণ। এই কর ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্য নিজেদের মধ্যে কর-রাজস্ব ভাগ করে নেয়। কিন্তু এর রূপায়ণ হল খুব তড়িঘড়ি। ছোট ও মাঝারি শিল্পপতিদের মতামতের কোন সুযোগ না দিয়ে। অধিকাংশ ছোট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জিএসটি-র আওতায় এনে ফেলা হয় কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই। ফলে, অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তা ছাড়া পেট্রোপণ্য জিএসটির আওতার বাইরে থেকে গেল। খোলা বাজারে পেট্রোপণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। কেন পেট্রোপণ্যের জিএসটি-র আওতায় আনা হল না? না সেই প্রশ্ন ‘৫৬ ইঞ্চি’কে করা যায়নি। ‘দুর্জন’-এ বলেন, ‘ঘনিষ্ঠ’ কিছু বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীকে সুবিধা করে দিতে এই পদক্ষেপ। এ হল ‘৫৬ ইঞ্চি’র দ্বিতীয় কুমির ছানা।
তৃতীয় পর্ব: মন্ত্রী, নেতাদের বক্তব্য প্রতিযোগিতা
সে এক বলার মতো প্রতিযোগিতা! গোমূত্র সেবনের উপকারিতা, গণেশের মাথার রহস্য, প্রাচীন ভারতে ইন্টারনেট থেকে পুকুরে কুমির— একের পর এক বক্তব্য। কাকে ছেড়ে কাকে শুনবেন! কিছু প্রতিবাদী কণ্ঠ। আর এই শোরগোলে বাস্তব সমস্যাগুলি দূরে সরে গেল। অর্থনীতির করুণ দশা, দেশের দক্ষিণ প্রান্তে ভয়াবহ জলসঙ্কট, বিমান সংস্থার রুগ্ন দশা, দীর্ঘদিন বেতন না পাওয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম সংস্থার কর্মীদের দীর্ঘশ্বাস। আড়ালে ‘ঘনিষ্ঠ’কে সঁপে দেওয়া হল পাঁচটি বিমানবন্দরের মালিকানা। এর মাঝে ‘৫৬ ইঞ্চি’কে কেউ কেউ, প্রশ্ন করলেন সংখ্যায় অল্প, গত ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্বের সংখ্যা কেন এত বেশি? কেন পোস্টঅফিস ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি রুগ্ন? কেন ঋণখেলাপিদের ফিরিয়ে আনা গেল না? কেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জন্য কিছু করা যাচ্ছে না? উত্তর মেলে সবই আগের রাজার দোষ। আগামী দিনে প্রশ্নও করা যাবে না। সৌজন্য আরটিআই বিলের অধুনা সংশোধনী। এ হল ‘৫৬ ইঞ্চি’র তৃতীয় কুমির ছানা।
চতুর্থ পর্ব: স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা
কথা ছিল, বিশ্বাসও ছিল, এক স্বচ্ছ দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন পাওয়া যাবে। প্রথম বারে হল না। তা হলে দ্বিতীয় বারে হবে নিশ্চয়? কথা দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এলে ৯০ দিনের মধ্যে সব কেলেঙ্কারি ফয়সালা করবেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে দেখা যাচ্ছে, এই সব কেলেঙ্কারির নায়ক, নায়িকারা ‘৫৬ ইঞ্চি’র দলের সদর দফতরে গিয়ে দলীয় সদস্যপদ গ্রহণ করছেন। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ক্রমেই সোনার পাথরবাটি। এ হল ‘৫৬ ইঞ্চি’র চতুর্থ কুমির ছানা।
পঞ্চম পর্ব: উপত্যকা ও সন্ত্রাসবাদ
দেশের উত্তরে বিপুল সেনা ও আধা সামরিক বাহিনীর সমাবেশ। কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়ল জনজীবন। শঙ্কার প্রহর গনা শুরু হল। এবং শঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ ধারাকে লোপ করে দেওয়া হল। একটি রাজ্যকে প্রায় কারও সঙ্গে আলোচনা না করে দু’টুকরো করে দেওয়া হল। প্রত্যাশিত ভাবে অনেকেই ধন্য ধন্য করে উঠলেন। এ বার তা হলে সত্যি সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হয়ে যাবে। অতি উৎসাহীরা আবার উপত্যকায় গিয়ে জমি কেনার কথা ভাবতে শুরু করলেন। ‘৫৬ ইঞ্চি’ জানালেন, এত দিন এই দু’ধারার জন্য রাজ্যটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে খুবই পিছিয়ে ছিল। এই ধারাগুলির জন্যই নাকি কোন উন্নয়ন ও বিকাশ হয়নি রাজ্যটির। তা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যানের দিকে একটু চোখ
রাখা যাক।
২০১৬-’১৭-এ ওই উপত্যকায় রাজ্যটির দারিদ্রের হার ছিল ১০.৩৫ শতাংশ আর দেশের দারিদ্রের হার ওই একই সময় ছিল ২১.৯২ শতাংশ। ছত্তীসগঢ়ে রাজ্যে দারিদ্রের হার ছিল সর্বোচ্চ। এখানে ‘৫৬ ইঞ্চি’র দলের সরকার ছিল বহুদিন। একই সময় জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৭৩.৫ বছর। যেখানে দেশের সর্বনিম্ন গড় আয়ু ৬৪.৫ বছর, উত্তরপ্রদেশে। সেখানেও ‘৫৬ ইঞ্চি’র দলের সরকার। সর্বভারতীয় গড় শিশু মৃত্যুর হার ৩১, সেখানে জম্মু ও কাশ্মীরে গড় শিশু মৃত্যুর হার ২৪। সূত্র জানাচ্ছে, জম্মু ও কাশ্মীরে মাথাপিছু আয় ৬২,১৪৫ টাকা। অন্য দিকে বিহারের মতো রাজ্যে মাথাপিছু আয় মাত্র ২৫,৯৫০ টাকা। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে জম্মু-কাশ্মীরের স্থান অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত ও বিহারের থেকে উপরে।
আসলে ধারাগুলি বিলুপ্তির টানটান উত্তেজনায় ঢাকা পড়ে যায় অর্থনৈতিক সঙ্কট। আমরা খেয়াল রাখি না এরই মধ্যে শেয়ারবাজারের বিশাল পতন। আমাদের নজর এড়িয়ে চলে যায় টাকার ক্রমাগত মূল্যহ্রাস। নিরুপায় হয়ে দেখি কমতে থাকা সুদের হার। আবাসন শিল্পে ও গাড়ির বাজারের অশনি সংকেত আমাদের অনেকের নজরে আসে না। ‘৫৬ ইঞ্চি’র পাঁচটি কুমির ছানা আমাদের ভুলিয়ে রাখে।
লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক