সঙ্গের ছবিতে মৃত হুকুম আলি শেখের পরিবার।
গত বছর ডিসেম্বরের কথা।
মেঘালয়ের অবৈধ কয়লা খনিতে আটকে পড়েন পনেরো জন শ্রমিক। উদ্ধারকার্যের আয়োজন নিয়ে সরকারি টালবাহানা সারা দেশে শোরগোল ফেলে দেয়।
সংসদে দাঁড়িয়ে বিজেপি সাংসদ লক্ষ্মণ গিলুয়ার (ঝাড়খণ্ড) শ্রমিকদের মৃত্যুর পরিসংখ্যান জানতে চান। তাতে ‘লেবার অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট মিনিস্ট্রি’ যে তথ্য দেয় তা অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত কয়লা, খনিজ সম্পদ ও তৈল উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত ৩৭৭ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় মারা যান। ২০১৫ সালে ১০৩ জন, ২০১৬ সালে ১৪৫ জন এবং ২০১৭ সালে ১২৯ জন মারা যান। কয়লা খনিতেই মৃত্যুর পরিসংখ্যান সবচেয়ে বেশি— ২১০ জন।
দুঃখের কথা, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়ে এই চর্চাটুকু আমাদের দেশে আজও সে ভাবে হয় না। কিন্তু কাদের বলব অসংগঠিত শ্রমিক? ‘Unorganized Workers Social Security Act, 2008’ অনুযায়ী অসংগঠিত শ্রমিক বলতে জানানো হয়েছে, ‘home-based worker or a self-employed worker or a wage worker in the unorganized sector and includes a worker in the organized sector who is not covered by any of the Acts pertaining to welfare Schemes…’।
দেশে প্রতি বছর এই অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মৃত্যু বা অঙ্গহানির ঘটনা আমাদের অজানা থেকে যায়। সমস্যার নিরসনও হয় না। সেই সমস্ত শ্রমিক পরিবারও এক প্রকার আর্থিক দুরবস্থায় জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। মনে পড়ছে, আমাদের পাশের গ্রামে দু’বছর আগে ইলেকট্রিকের কাজ করতে গিয়ে এক যুবকের মৃত্যুর কথা। কিংবা গত বছর দীনবন্ধু দাস নামে এক প্রতিবেশীর বাড়ি নির্মাণের জন্য ইট বইতে গিয়ে মাথায় আঘাত লেগে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর কথা। নিরাপত্তাহীন এই ব্যবস্থার দিকে ফের আঙুল তুলল সাম্প্রতিক আরও একটি মৃত্যু।
দু’দিন আগেই ফসল ঝাড়াইয়ের যন্ত্রে মাথা ও শরীরের অংশ জড়িয়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে হোগলবেড়িয়ার শেখপাড়ার হুকুম আলি শেখের। এই ধরনের মৃত্যুর কারণ হিসাবে দায়ী করা যেতে পারে যন্ত্র ব্যবহারের অদক্ষতাকে। হুকুম শেখ যেমন মুসুর ডাল ঝাড়াই করার সময়ে যন্ত্রে কিছু শুকনো মুসুর গাছ আটকে যাওয়ায় যন্ত্র চালু থাকা অবস্থাতেই ঢাকনা খুলে সেগুলি বের করার চেষ্টা করছিলেন। মাথায় বাঁধা গামছা চলন্ত যন্ত্রের ভিতরে বড় পাখায় জড়িয়ে যায়। তাঁর শরীরের ঊর্ধ্বাংশ যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে যায়। যন্ত্রের ব্যবহার না জানা কিংবা জেনেও নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখানোর জেরে এই ধরনের বিপদ প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। এর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য দরকার সরকারি বা বেসরকারি ভাবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও সচেতনতামূলক বিভিন্ন শিবির আয়োজন করা। এবং ব্যবহারের বিধিনিষেধের উপর আইন প্রণয়ন করে প্রশাসনিক স্তরে তা কঠোর ভাবে দেখভাল করা।
যে সব পরিবার এই ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয়, তাদের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েরই বিভিন্ন প্রকল্প আছে। যেমন ‘প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বিমা যোজনা’ (পিএমএসবিওয়াই)। যদি কোনও পরিবারের এক রোজগেরে সদস্য চিরতরে প্রতিবন্ধী হয়ে যান বা তাঁর আকস্মিক মৃত্যু হয়, তা হলে তাঁর পরিবার কোনও প্রতিষ্ঠান বা কর্মগোষ্ঠীর থেকে সুরক্ষা বা সহায়তা না পেয়ে দারিদ্র্য ও কষ্টকর জীবনের সম্মুখীন হয়। এই ‘পিএমএসবিওয়াই’ প্রকল্পে যোগদানের মাধ্যমে এবং বছরে মাথা পিছু নামে মাত্র ১২ টাকা প্রিমিয়াম দিলে, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বা স্থায়ী সম্পূর্ণ প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে দু’লাখ টাকার বিমা এবং আংশিক প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে এক লাখ টাকা পর্যন্ত বিমা পাওয়া যায়।
এখানে বলতে হবে ‘সামাজিক সুরক্ষা যোজনা’র কথা। অসংগঠিত শ্রমিকদের বার্ধক্যজনিত দুর্দশা, জীবন সংগ্রাম, শারীরিক অক্ষমতা ও অসমর্থতা, সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব, রোগ নিরাময় ইত্যাদি ক্ষেত্রে সক্ষম করে তোলার কথা মাথায় রেখে তাঁদের আয় সুনিশ্চিত করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রচলিত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকে একত্রিত করে একটি প্রকল্পে পরিণত করেছে। সকল শ্রমিককে সমান সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে ‘সামাজিক সুরক্ষা যোজনা, ২০১৭’ গোটা রাজ্যেই চালু হয়েছে। শ্রমিক সাথী নম্বর ১৮০০১০৩০০০৯ (টোল ফ্রি)-তে যোগাযোগ করে এই সুবিধা সম্পর্কে জানা যায়।
কিন্তু অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে এই প্রকল্পগুলি সম্পর্কে যে সচেতনতা প্রয়োজন, তা খুবই কম। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে বিভিন্ন শ্রমিক মেলা হলেও সেখানে এই শ্রমিকদের যোগদান অপ্রতুল। ফলে অধিকাংশ শ্রমিক তাদের অধিকারের কথা জানতেই পারেন না। সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে শ্রমিক ও তাঁর পরিবার বঞ্চিতই থেকে যায়। সরকারি ও অসরকারি উদ্যোগে এই সচেতনতা গড়ে তোলা খুবই প্রয়োজন। না হলে এই ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মৃতের বা আহতের পরিবারের বিপাকে পড়ার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।
মনে রাখতে হবে, এ দেশে অসংগঠিত শ্রমিকদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যার ৯৩% শ্রমিকই অসংগঠিত। তাই দেশের সার্বিক বিকাশের স্বার্থে তাঁদের মূলস্রোতে নিয়ে আসা, অন্তত যথাসম্ভব সুরক্ষিত রাখাটা প্রয়োজন।
চাপড়া সরকারি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক