দিদিমণি রোজ খোঁজ নেন। রোল নম্বর সতেরো স্কুলে আসছে না সপ্তাহখানেক। শরীর খারাপ? বাড়িতে অনুষ্ঠান? বেড়াতে গিয়েছে? কী সমস্যা? মেয়েরা উত্তর দেয় না। মুখ দেখে মনে হয়, জানে অনেক কিছু। অনেক জিজ্ঞাসার পর কেউ হয়তো রহস্য উন্মোচন করে “দিদি, ও ঘুরছে।” দিদিমণি আঁতকে ওঠেন, “সে কী! সবে তো ক্লাস এইট?” বন্ধুকে দিয়ে তাকে ডেকে পাঠানো হয় বার বার। রোল নম্বর সতেরো এক বার আসেও। তাকে বোঝানো হয়। অভিভাবককে বোঝানো হয়। এখন স্কুল থেকে খাবার, খাতাবই, জামাজুতো সব পাওয়া যায়। লেখাপড়া চালিয়ে পাশ করলে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়। তাঁরা শোনেন। ঘাড় নাড়েন। তার পর এক দিন মেয়ে উধাও। হতে পারে বাড়িতে কষ্ট ছিল খুব। হতে পারে, কেবল ভাল থাকার স্বপ্ন দেখেছে সে। কিন্তু সব কিছুর মূলেই থাকে একটি ধারণা। কোনও ছেলের সঙ্গে সংসার পাতলেই জীবনে সুখ আসবে। মেয়েদের বিয়ের বয়স আঠারো হোক বা একুশ, এই ধারণা বৃদ্ধ হয় না।
ক্লাস এইটের উধাও ছাত্রী সিঁদুর পরে বা সিঁদুর মুছে এক দিন বাড়ি আসে। ভাগ্যিস আসে। কারণ তার কিশোরী জীবন যৌবনের অত্যাচার বা পাচার হয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র সে সহ্য করতে পারত না। আর যদি সে ফিরতে না পারে? সুখের সংসারের স্বপ্ন কি সত্যিই সফল হয় তার? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় না। সে পরিণতি ভয়াবহ। অনেক সময় ছাত্রী নয়, মেয়ের বিয়ে দিয়ে ‘দায়মুক্ত’ হতে চায় তার পরিবার। সায়েন্স পড়া মেয়ে হাতে শাঁখা পরে লাস্ট বেঞ্চে বসে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক বাবা মা স্কুলে এসে বলেন, “প্রিটেস্ট না দিলে হবে? ওর বিয়ে।” দাদু অসুস্থ, তিনি দেখে যেতে চান বলে বিয়ে দিতে হবে নাবালিকার। দিদিমণিরা প্রথমে বোঝান। পরে থানাপুলিশ করেন। অনেক সময় ছাত্রী নিজেই বেঁকে বসে দিদিমণিদের অনুরোধ জানায় বিয়ে বন্ধ করতে। এও দেখা যায়, মা বাবা হয়তো কারও প্রতি ঋণী। সেই ঋণ পরিশোধ হচ্ছে মেয়েকে তার হাতে তুলে দিয়ে।
করোনাকালে শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় বসা অসম্ভব জেনেও অনেক অভিজ্ঞ ব্যক্তি ভাবছেন, পরীক্ষাটা হলেই হত। দরিদ্র ভারতের মেয়েদের এক বছর নষ্ট মানে হয়তো লেখাপড়াই শেষ। বাড়ি থেকে হয়তো বিয়ে দিয়ে দেবে। পরিসংখ্যানেও ইদানীং এ দেশের মেয়েদের বাল্যবিবাহের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পরিস্ফুট হচ্ছে। অথচ এর পরিণতি? দারিদ্র, প্রবল পরিশ্রম, গার্হস্থ হিংসা, শরীরের উপর বয়সবিরুদ্ধ যৌনাচার। কিশোরী মা শিশুসন্তান ও সংসার নিয়ে জেরবার হয়ে যায়। তার ছাত্রজীবন শেষ, পড়াবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও শ্বশুরবাড়ি পড়ায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি, বিয়ের নামে কোথাও পাচার হয়ে যাওয়া। এই দুর্দশা একুশে বিয়ে হলে কমতে পারে, এ কথা হিসেব বলে। সেই কারণে কেন্দ্রের প্রস্তাবিত বিয়ের নতুন বয়সকে স্বাগত না জানাবার কিছু নেই। কিন্তু মেয়েদের জীবনদর্শন নিয়ে তথাকথিত ‘সাংসারিক’ দৃষ্টিভঙ্গি যত দিন না বদলাবে, বিয়ের বয়স দশ বছর বাড়িয়ে দিলেও ভারতীয় নারী রক্ষা পাবে না।
‘বিবাহ’ শব্দটির গুরুত্ব অনেক। শুধু রোমান্টিকতা নয়, রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম এই প্রতিষ্ঠানের সামাজিক, সাংসারিক এবং মানবিক তাৎপর্য অসীম। কিন্তু সাদা বাংলায় ‘বিয়ে’ মানুষের কিছু বিশেষ প্রবৃত্তিকে একটি সামাজিক বাঁধন দেয়। উদ্দেশ্য, কারও দ্বারা কেউ যেন অন্যায় ভাবে শোষিত না হয়। বাস্তবে তা ঘটে কি? বিবাহ পরবর্তী গার্হস্থ হিংসা, বধূর আত্মহত্যা, ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যাওয়ায় মেডেল পাওয়া ভারত কী বলে?
ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু সংখ্যার দিক দিয়ে তা তুলনায় আসতে পারে না। এক বার একটি ওয়ার্কশপ করানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল এলাকার এক নামী স্কুলের ছাত্রীদের মায়েদের নিয়ে। এঁরা কেউ অভাবী নন। সংসারে মারাত্মক অত্যাচারিতও নন। প্রত্যেকেই মেয়েদের নিয়ে সারা দিন ঘুরছেন স্কুল, প্রাইভেট টিউটর, গানের ক্লাস ইত্যাদিতে। কেউ ভাল নাচতেন, কেউ গাইতেন, কেউ খেলতেন। এখন আর চর্চা নেই। সংসার আছে। সবচেয়ে বড় কথা, মেয়ে আছে। প্রশ্ন করলাম, আপনাদের মেয়েরা গান শিখে, লেখাপড়া করে যদি আপনাদেরই অনুসরণে তাদের কেরিয়ারও বিসর্জন দেয় তাদের ছেলেমেয়ের জন্য, তা হলে মেয়েদের প্রতিভার প্রতি সুবিচার ঠিক কোন প্রজন্মে গিয়ে হবে? বিরাট হলঘর অস্বাভাবিক রকম নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সে দিন।
সন্দেহ নেই, ভারতীয় নাবালিকার বিবাহের মূলে দারিদ্র প্রধান কারণ। কিন্তু তার পরও বলতে হয়, এই দেশ এখনও আদিমতার সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরোতে পারেনি, যেখানে নারীর পূর্ণতার পথের প্রথম মাইলস্টোনই বিয়ে (প্রেম নয়)।
মেয়েদের বিয়ের বয়স একুশ হলে এ দেশের শিক্ষিত সমাজ নিশ্চয় তাকে স্বাগত জানাবে। কিন্তু মেয়েদের শক্তি, প্রতিভা, যোগ্যতা এবং ‘সহনাগরিক’ হিসেবে তাদের গুরুত্ব উপলব্ধির জন্য যে সুস্থ বোধ এবং পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক সঙ্গতি প্রয়োজন, তার পরিধি বাড়ানোর জন্য সরকারের কী পরিকল্পনা আছে, জানার আগ্রহ রইল। কারণ অদ্যাবধি ভারতের অধিকাংশ ‘বেটি’ পড়া তো দূরের কথা, সুস্থ ভাবে বাঁচতেও পারছে না।