Government Job

চাকরির দানসত্র ও ঘুঘুর বাসা

বেশ কয়েক বছর ধরে নির্বাচক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এড়িয়ে নানা অছিলায় রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারি চাকরি বিলানোর প্রবণতা এ রাজ্যে বেড়েই চলেছে।

Advertisement

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২০ ০০:০২
Share:

সম্প্রতি রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে, কোভিড যুদ্ধে কোনও সরকারি কর্মীর মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারের এক জন সদস্যকে চাকরি দেবে রাজ্য সরকার। যাঁরা সকল বিপদ তুচ্ছ করে প্রশাসনকে সচল রেখে মানুষের কাছে যাবতীয় পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে দিবারাত্রি পরিশ্রম করে চলেছেন, তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে সুবিবেচনাপ্রসূত মনে হয়। কিন্তু, কর্মরত অবস্থায় সরকারি কর্মীর মৃত্যু হলে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে পারিবারিক বার্ষিক আয়ের নিরিখে যোগ্য বিবেচিত পরিবারের এক জন সদস্যকে চাকরি দেওয়ার সংস্থান বহু দিন ধরেই বহাল রয়েছে। তাই প্রশ্ন, নতুন করে এই সরকারি সিদ্ধান্তের পিছনে কোন ভাবনা কাজ করছে? কোনও রাজনৈতিক ভাবনা নয় তো?

Advertisement

এই প্রসঙ্গে কতগুলি কথা মনে করা যেতে পারে। ২০১২ সালে সরকারি দফতরগুলিতে দ্রুত কর্মী নিয়োগের জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্টাফ সিলেকশন কমিশন গঠন করেছিল। কিন্তু আশানুরূপ দ্রুততায় কর্মী নিয়োগে অসমর্থ হওয়ায় এবং নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ২০১৭ সালে সেই কমিশন বন্ধ হয়ে যায়।

এর আগে গ্রুপ ‘এ’ থেকে গ্রুপ ‘সি’ (বাম জমানার অন্তিম পর্বে গ্রুপ ‘ডি’ও অন্তর্ভুক্ত হয়) পর্যন্ত সমস্ত স্তরে কর্মী নিয়োগের জন্যে পরীক্ষা গ্রহণ ও সুপারিশের দায়িত্ব ছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এক্তিয়ারভুক্ত। বিগত কয়েক বছরে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিরুদ্ধেও ক্রমাগত নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এমনকি রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ আমলা নিয়োগের পরীক্ষার (ডব্লিউবিসিএস) মেধা তালিকায় কারচুপি নিয়েও সম্প্রতি কম জল ঘোলা হয়নি।

Advertisement

শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন সকলের জন্যে উন্মুক্ত সরকারি কর্মচারী নিয়োগের এই প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় অন্তত মেধা যাচাইয়ের একটা ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে নির্বাচক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এড়িয়ে নানা অছিলায় রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারি চাকরি বিলানোর প্রবণতা এ রাজ্যে বেড়েই চলেছে। কোনও দুর্ঘটনায়, সামাজিক অন্যায়ের কারণে বা রাজনৈতিক হিংসায় কারও মৃত্যু হলে নেতা-নেত্রীরা মিডিয়ার সামনে সেই পরিবারের এক জনকে সরকারি চাকরি দেওয়ার ঘোষণা এমন ভাবে করেন, যেন সরকারি চাকরি আসলে তাঁদের মর্জিমাফিক দানখয়রাতির অঙ্গ।

সরকারের প্রতিটি দফতরেই এখন প্রচুর শূন্য পদ। ২০১১ সালে রাজ্যে সরকারি কর্মীর যে সংখ্যা ছিল, এখন তার প্রায় অর্ধেক। এই অবস্থায় স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ নানা অজুহাতে বিলম্বিত করে ঘুরপথে দলীয় সমর্থকদের নিয়োগের জন্যে সরকার কয়েকটি অদ্ভুত কৌশল নিয়েছে। দানখয়রাতির পাশাপাশি এই কৌশলগুলির অন্যতম হল, চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ।

বর্তমানে সরকারের এমন কোনও দফতর নেই, যেখানে এই কর্মী নিয়োগ হয়নি। যে হেতু এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্যে কোনও যোগ্যতা নির্ণায়ক বাছাইয়ের অবকাশ নেই, তাই তাঁদের একমাত্র যোগ্যতা হল শাসক দলের প্রতি আনুগত্য। দফতরগুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীদের পুনর্নিয়োগের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। অবসরপ্রাপ্তদের অভিজ্ঞতা ও অপরিহার্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও সরকারের প্রতি আনুগত্য পুনর্নিয়োগের অন্যতম যোগ্যতা।

আর একটা কুপ্রথা বহু দিন ধরেই চলে আসছে। প্রতিটি দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী প্রতি বছর দু’জন করে পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করতে পারেন। অর্থাৎ মন্ত্রীরা পাঁচ বছরে দফতরপিছু দশ জনকে সরকারি চাকরি দেওয়ার অধিকারী।

কর্মসংস্থানের এই ভয়ানক আকালের সময়ে এ ভাবে চুক্তি, দাক্ষিণ্য, পুনর্নিয়োগ বা মন্ত্রীদের বিশেষ ক্ষমতাবলে সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারি কর্মী নিয়োগ লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত এবং যোগ্য কর্মপ্রার্থীকে বঞ্চিত করছে। উপরন্তু, যাঁরা এ ভাবে নিযুক্ত হচ্ছেন, তাঁরা প্রথম দিন থেকেই জানেন, এঁদের চাকরির নিরাপত্তা কিংবা স্থায়ীকরণ, কোনওটাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা কিংবা সুপারিশের উপর নির্ভর করে না। পুরোটাই প্রকৃত নিয়োগকর্তা দাদা-দিদিদের এক্তিয়ারভুক্ত। ফলে কার্যালয়ে এঁদের উপস্থিতি বা দায়িত্ব পালন, পুরোটাই ব্যক্তিগত বা সেই দাদা-দিদির মর্জিমাফিক। রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে নিবিড় নৈকট্যের অধিকারী হওয়ার সুবাদে তাঁরা মনে করেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা, পোস্টিং-সহ অনেক সুযোগসুবিধাই বরং তাঁদের হাতে।

অনেক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও তাঁদের এই অন্তহীন ক্ষমতাকে সমীহ করে চলেন। তাই সরকারি আইনকানুনের কেতাবে যা-ই লেখা থাক না কেন, এঁদের খুশি করতে গিয়ে অনেকেই রাজনৈতিক ইচ্ছা অনিচ্ছার দাস হয়ে পড়ছেন।

হরেক প্রশাসনিক দুর্নীতির উৎস উদঘাটন-কল্পে যদি কোনও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়, তা হলে দেখা যাবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ একটা বড় কারণ। স্বচ্ছ প্রশাসন তৈরির জন্য এই চাপ সুসংবাদ হতে পারে না।

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement