সাধারণ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কথা লিখিয়া পরিবেশ সচেতনতার দায় সারিতে পারে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে বেতার বার্তায় সেই কথাগুলিই বলিলে মুশকিল। দ্বিতীয় দফার প্রথম ‘মন কি বাত’-এ তিনি জল সংরক্ষণের প্রসঙ্গ টানিয়াছেন। দেশ, এবং বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় গত কয়েক দিন যাবৎ জল লইয়া যে বিপুল আলোড়ন চলিতেছে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয় নির্বাচনে তাহার ভূমিকা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী যখন, তাঁহার ভাষণে আরও একটু তৎপর হওয়া বিধেয় ছিল। জলসঙ্কটের সহিত ফেক নিউজ় বা অনলাইন পাইরেসির ন্যায় সমস্যার একটি চরিত্রগত প্রভেদ আছে— জলসঙ্কট বহু দিনের সমস্যা, তাহা লইয়া বিস্তারিত গবেষণাও চলিতেছে বহু দিন যাবৎ। ফলে, সঙ্কটের চরিত্র ও ব্যাপ্তি যেমন জানা, তেমনই কোন পথে হাঁটিলে সমাধান সম্ভব, তাহাও জানা। টুইটারে নূতন হ্যাশট্যাগ চালু করিয়া সমাধানের খোঁজ করিবার প্রয়োজন এই ক্ষেত্রে নাই। প্রধানমন্ত্রী বহু ব্যস্ততায় থাকেন, কিন্তু জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিবার আগে খোঁজটুকু করিবেন না? না কি, জনশক্তি আর জলশক্তি মিলাইয়া স্লোগান তৈরি করিতে পারিলেই সমস্যার সমাধান হইয়া যায়?
প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, প্রতিটি জলবিন্দু সঞ্চয় করিতে হইবে। অতি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু, ভূগর্ভস্থ জলের কয় শতাংশ সাধারণ মানুষের গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত হয়, আর কয় শতাংশ যায় কৃষিতে, শিল্পে— সেই হিসাবটি বলা হয় নাই। সেখানেই সমস্যা। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক মাধ্যমেও তাই বাথরুমের ফ্লাশ হইতে পানীয় জলের ‘আর ও ফিল্টার’, সবের বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষিত হইতেছে। সেই জল বাঁচাইলেই কি সমস্যা মিটিবে? উত্তরটি, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, না। ভূগর্ভস্থ জলের দুই প্রধানতম দাবিদার কৃষি ও শিল্পে এই জলের ব্যবহারে রাশ না টানিলে সমস্যা মিটিবার নহে। এই দুইটি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করা, দুই গোত্রের কারণে, রাজনৈতিক ভাবে বিপজ্জনক। নেতারা কৃষি বিষয়ে কোনও নেতিবাচক কথা বলিতে ডরান, পাছে ভোট কমিয়া যায়। জলসঙ্কটের ক্ষেত্রে আরও বড় কারণ আছে। এত বৎসরেও গোটা দেশে বৃহৎ সেচের ব্যবস্থা হইল না, এখনও ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভর করিতে হইতেছে, এবং দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনও সবুজ বিপ্লবের ভুলের বোঝা বহন করিতেছে— এই সব ব্যর্থতার কথা স্বীকার করিবার সাহস কাহার? ফলে, বাবুরাম সাপুড়ের সাপের মাথায় ডান্ডা মারিয়া দায় সারিবার চেষ্টা চলিতেছে।
শিল্পক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ জলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের প্রশ্নটিও নেতাদের নিকট অনুল্লেখ্য। কারণ, শিল্প বেনিয়মে চলিতে চাহিলে তাহাকে চলিতে দেয় রাষ্ট্র। যথেষ্ট কঠোর আইন প্রণয়ন না করিয়া, বর্তমান আইনের ফাঁকফোকরগুলি বন্ধ না করিয়া। এবং, সংস্থাগুলিকে তাহাদের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ‘এক্সটার্নালিটি’ বা অতিক্রিয়ার দায় বহন করিতে বাধ্য না করিয়া। কেন রাজনৈতিক নেতারা এই কাজগুলি করেন না, তাহা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু, পরিবেশরক্ষায় শিল্পক্ষেত্রকে তাহার দায় ও দায়িত্বের কথাগুলি যে স্মরণ করাইয়া দেওয়া হয় না, তাহা প্রশ্নাতীত। সোশ্যাল মিডিয়ার আমজনতার এত কথা জানিবার দায় নাই— তাহারা স্বচক্ষে বিপদের যতটুকু দেখিতেছে, নিজেদের মতো করিয়া তাহার সমাধানসূত্র খুঁজিতে সচেষ্ট। কিন্তু, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যদি জলসঙ্কট সমাধানের দায়টি সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপাইয়া দেন, তবে মূল ও বৃহত্তর সমস্যাগুলি প্রশ্নের বাহিরেই থাকিয়া যায়। রাষ্ট্র, এবং তাহার পরিচালকদের দায়িত্বের কথাটি জনপরিসরে আলোচিতই হয় না। প্রকৃত প্রশ্নগুলিকে আলোচনার কেন্দ্রে আনিবার সুযোগ প্রধানমন্ত্রীর ছিল। তবে, জলসঙ্কটের আসল কারণগুলিকে চির কাল অবহেলা করা অসম্ভব। আশা, নেতারা নিজেদের দায়িত্বের কথা মানিবেন, প্রকৃত প্রশ্নগুলির সমাধানসূত্র খুঁজিবেন।