কথায় বলে ‘জলের দর’, কিন্তু জলের দাম যে কত চড়া, হাড়ে হাড়ে বোঝেন চাষি। বিশেষত যদি বৃষ্টি ভাল না হয়, বর্ষার ধান চাষেও বার বার সেচ লাগে, মাথায় হাত পড়ে চাষির। এ বছর পূর্ব বর্ধমানের বিস্তীর্ণ এলাকায় বৃষ্টির অভাবে মার খেয়েছে ধান।
পশ্চিমবঙ্গে ভাল বৃষ্টি হয়, রয়েছে প্রচুর নদী। ভূগর্ভস্থ জল বিস্তর। কিন্তু, জলের জোগান থাকলেই হল না। চাষি তা কী শর্তে পাচ্ছেন, তাও দেখতে হবে। ধরা যাক, কাছেই নদী বা বড় দিঘি আছে। কিন্তু তা থেকে সেচের জল তোলার ব্যবস্থা কে করবে? হয়তো চাষের জমির কাছেই বড় সেচখাল আছে। কিন্তু তাতে জল কবে ছাড়বে, জানা যাবে কী করে? জল ছাড়ার কত আগে জানা যাবে? চাষি প্রস্তুত না থাকলে (যেমন, আগে থেকে ধান বুনে না রাখলে) জল ছাড়লেও কাজে লাগাতে পারবেন না।
এ রাজ্য নদী-দিঘির জলে যত জমির সেচ হয়, ভূগর্ভস্থ জলে হয় তার দ্বিগুণেরও বেশি। অধিকাংশ চাষি সে জল কেনেন পাম্প-মালিকের কাছে। নদী-দিঘির জল ব্যবহারের সুযোগ যেখানে আছে, সেখানে পাম্পসেটের ভাড়া ঘণ্টায় ২০০-৩০০ টাকা। সেচনির্ভর বোরো ধান ফলাতে ধানের প্রাণকেন্দ্র পূর্ব বর্ধমানে অন্তত তিন বার সেচ লাগে। ফি বার প্রতি বিঘায় অন্তত তিন ঘণ্টা জল দিতে হয়।
সরকারি সেচ প্রকল্পের পাশে কাজ করতে পারে বেসরকারি জলের বাজার। কংসাবতী জলাধার তৈরির মূল লক্ষ্য ছিল বোরো চাষে পর্যাপ্ত জল পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু জলাধার থেকে জল ছাড়ার সময়টা চাষের চাহিদার সঙ্গে মেলে না। জল কবে মিলবে, সে খবরও আসে দেরিতে। তাই কংসাবতীর ‘ক্যাচমেন্ট’ এলাকায় ব্যক্তিগত মালিকানার গভীর নলকূপ অগুনতি। যেখানে নদীর জল বিনামূল্যে পাওয়ার কথা, সেখানে চাষি জল কেনেন চড়া দামে। এ ছবি দেশের প্রায় সর্বত্র। উত্তরপূর্ব ভারতে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, নদীসিঞ্চিত এলাকায় জল কেনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
অতএব সেচের জল পেতে তিনটে বিষয় নিশ্চিত করতে হবে চাষিকে। পাম্প কেনা বা ভাড়ার করার টাকা থাকতে হবে; সেচ খালে কবে জল ছাড়বে, জানতে হবে; জল পাওয়ার উপযোগী সামাজিক সম্পর্ক থাকতে হবে। ওই সম্পর্কেই নিহিত থাকে ক্ষমতার বিন্যাস। অনেক চাষি জল কেনেন ধারে। পাম্প মালিকের উপর নির্ভরতা মরসুমের গোড়ায় শুরু হয়। ফসল বাজারে বিক্রি পর্যন্ত চলতে থাকে। চাষির লাভ খেয়ে যায় জলের দর।
প্রতিকার কী? প্রাকৃতিক সম্পদে সবার সমান অধিকার। তা কিছু লোককে অবাধে বেচতে দেওয়া হবে কেন? বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমাধান ছিল, জলবণ্টন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। ভারতে পঞ্চাশ-ষাটের দশক অবধি সেচ নিয়ে মাথা ঘামাতেন প্রধানত ইঞ্জিনিয়াররা। সত্তর-আশির দশকে নজরে এল, বড় মাপের সেচ প্রকল্পগুলি ঘোষিত এলাকার তুলনায় অনেক কম এলাকায় জল পৌঁছে দিতে পারছে। বোঝা গেল, সেচ সামাজিক সম্পর্কের অঙ্গ, তাই তার ব্যবস্থাপনায় সমাজের ভূমিকা থাকা দরকার।
তার উপায় জলবণ্টনে মানুষের যোগদান। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বিকেন্দ্রীকরণের উপর জোর দেওয়া শুরু হয়। অন্ধ্রপ্রদেশ ও সম্প্রতি মহারাষ্ট্র এ বিষয়ে ভাল কাজ করেছে। বিশেষত মহারাষ্ট্রে গত ক’বছরের খরা জলবণ্টনে সংস্কারকে ত্বরান্বিত করেছে। বিকেন্দ্রীকরণ ‘মডেল’ বলে: সেচের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ দেখবে গ্রামের ‘জল কমিটি’। এতে সকলের মত গুরুত্ব পাবে। গ্রামবাসীর খুঁটিনাটি জ্ঞান কাজে লাগালে সুব্যবহার হবে জলের। কমবে জলবণ্টন নিয়ে ক্ষমতার খেলা। গ্রামবাসীরা তাই সরকারি নীতির অনেক আগে থেকেই কিছু এলাকায় এমন কমিটি তৈরি করেছেন।
তবে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রস্তাবের সমস্যাও আছে। বিকেন্দ্রীকরণের একটি প্রধান উদ্দেশ্য: সেচব্যবস্থার স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। তাই ব্যাঙ্ক চায়, সেচের জলের মূল্য নির্ধারিত করতে হবে, বিঘে বা একর প্রতি নয়, ঘনত্বের ভিত্তিতে। এর জন্য সেচ ব্যবস্থায় আমূল বদল চাই। তাতে চাষির স্বার্থ সুরক্ষিত হবে কি না, সন্দেহ আছে। সম্ভবত এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেক রাজ্যই জলের বিকেন্দ্রীকরণে ‘ধীরে চল’ নীতি নিয়েছে।
কিন্তু তাতে চাষির লাভ কী হচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গে গত সাত বছরে সেচ প্রকল্পে বরাদ্দ প্রায় আটগুণ বেড়েছে। ২০১৮-১৯’এ ৩১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। অর্থাৎ সরকার চাষির কাছে জল সহজলভ্য করতে চায়। কিন্তু গ্রামে গ্রামে ব্যক্তিমালিকানাধীন সেচ ব্যবস্থা এক অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি বাজার তৈরি করেছে। সরকারি আধিকারিকদের কাছেও তার কোনও তথ্য নেই। ২০১৩-১৪’য় সরকার গভীর নলকূপ স্থাপনে এককালীন অর্থ বরাদ্দ করেছিল। অনেক অঞ্চলে তার জল নিয়ে ব্যবসা চলছে।
চাষকে লাভজনক করতে হলে সেচ নীতি নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণ কি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির রোজগার ও সক্ষমতা বাড়াতে পারে? না হলে আর কী বিকল্প রয়েছে চাষির কাছে সুলভে জল পৌঁছে দেওয়ার, তা নিয়ে চিন্তা প্রয়োজন।
ড. এ পি জে আব্দুল কালাম গভর্নমেন্ট কলেজে নৃতত্ত্বের শিক্ষক