আনন্দ পটবর্ধনের ‘রাম কে নাম’
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামান্য উপাচার্য সাংবাদিকের ফোন ধরেন নাই। অতীতেও বিভিন্ন উপলক্ষে এমনই দেখা গিয়াছে। তাঁহার ফোন, তিনি না-ই ধরিতে পারেন। তবে কিনা, ফোন ধরিবার কিছু সুফল থাকে, বিভিন্ন বিষয়ে উপাচার্যের মতামত জানিলে সমাজ সংসার উপকৃত হয়, তাঁহার জ্ঞানের আলোয় আমজনতার মনের অন্ধকার দূর হয়। তাহা না হইলে সন্দেহের কাঁটা খচখচ করিতেই থাকে। যথা, আনন্দ পটবর্ধনের ‘রাম কে নাম’ তথ্যচিত্র প্রদর্শনের অনুমতি ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হইল না কেন? এই ছবির প্রদর্শন লইয়া শোরগোল উঠিবার পরেই কেন নির্দেশ জারি করা হইল যে, প্রেসিডেন্সির প্রেক্ষাগৃহে কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনও অনুষ্ঠান করা যাইবে না! ছবিটি দেখাইতে না দিবার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে বিচিত্র অজুহাত দিয়াছেন, তাহাতে এই সংশয় ঘনীভূত হয় যে, মহামান্য উপাচার্য ও তাঁহার সহযোগীরা আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। ভয়ের নিকট আত্মসমর্পণ, ক্ষমতার নিকট আত্মসমর্পণ। ‘রাম কে নাম’ ছবিটি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারবারিদের চক্ষুশূল। তাঁহারা অনেক স্থানে এই ছবির প্রদর্শনে বাধা দিয়াছেন। সম্প্রতি হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তথ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন কেবল বন্ধ করা হয় নাই, ছাত্রদের গ্রেফতারও করা হইয়াছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও এই ছবি দেখাইবার উদ্যোগ প্রতিহত করিতে হিন্দুত্ববাদীরা তৎপর হইয়াছিলেন। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। অর্থাৎ যাদবপুরের কর্তারা পারিয়াছেন, প্রেসিডেন্সির কর্তারা পারেন নাই। পারিবার চেষ্টাও করেন নাই।
সম্ভবত উপাচার্য ও তাঁহার সঙ্গীরা ভাবিয়াছেন, পাইকারি ভাবে রাজনীতি বর্জনের কথা ঘোষণা করিয়া দিলে আর হিন্দুত্ববাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অভিযোগ উঠিবে না। এই সংশয় সত্য হইলে মানিতেই হইবে, এতদ্দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় স্বধর্মকেই অস্বীকার করিতেছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি-আলোচনা শুধু অনুমোদনযোগ্য নহে, অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ‘অশান্তি দমন করিয়া পঠনপাঠনের সুপরিবেশ প্রতিষ্ঠা’র যুক্তি দেখাইলে তাহা হইবে বিশুদ্ধ ছেঁদো কথা। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে রাজ্যের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কুৎসিত দলতন্ত্রের তাণ্ডব চলিয়া থাকে, তাহা বন্ধ করার সহিত রাজনৈতিক আলোচনার কোনও সম্পর্ক নাই। যথার্থ রাজনীতি চর্চা উচ্চশিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় সেই অঙ্গ ছিন্ন করিলে সর্বাগ্রে ছিন্ন হইবে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়োর ঐতিহ্য। পরবর্তী কালেও এই প্রতিষ্ঠান সেই প্রশ্নবাচী তর্কশীলতার ধারায় অবিচল থাকিয়াছে। ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি বস্টন বা সরবোন-এর পাশাপাশি প্রেসিডেন্সিকেও কী ভাবে নাড়া দিয়াছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিচালকরা না জানিলে জানিয়া লইতে পারেন।
তবে এই সকল আক্ষেপই নিষ্ফল। পরিচালকরা সম্ভবত স্থির করিয়াছেন, পুরানো ঐতিহ্য ঢাকিসুদ্ধ বিসর্জন দিয়া নূতন ঐতিহ্য সৃষ্টি করিবেন। প্রকৃত বিশ্ববিদ্যার সাধনা নহে, সিলেবাস মুখস্থ করাই হইবে এই নব-প্রেসিডেন্সির ব্রত। জ্ঞানান্বেষণের লক্ষ্য নহে, বাজারের প্রয়োজন অনুযায়ী ছাঁচে ঢালা মানবসম্পদ উৎপাদন করিয়া ভাল ‘প্লেসমেন্ট’-এর বন্দোবস্ত করিতে পারিলেই সেই ব্রত সুসম্পন্ন হইবে। সর্বোপরি, সমস্ত বিষয়ে প্রশ্ন করিবার, তর্ক তুলিবার সতেজ মন নহে, ক্ষমতার নির্দেশ বিনা প্রশ্নে মানিয়া লইয়া নিজ নিজ পাঠে মন দিবার আনুগত্যই সেই ব্রতের লক্ষ্য। প্রেসিডেন্সি যে সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রতীক, তাহার অন্তর্জলি যাত্রা সম্পন্ন হইবে। ভরসা কেবল একটিই— ছাত্রছাত্রীরা। যাঁহারা সমস্ত বাধাবিপত্তি অস্বীকার করিয়া ‘রাম কে নাম’ দেখাইয়াছেন এবং দেখিয়াছেন। এই প্রতিষ্ঠান যদি স্বধর্মে স্থিত থাকিয়া আত্মমর্যাদা সহকারে বাঁচে, তাঁহাদের জন্যই বাঁচিবে।