Pranab Mukherjee

প্রকৃত অর্থে সেকুলার ছিলেন তিনি, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় কৌশিক বসু

যত দিন গিয়েছে, ততই তাঁকে চিনেছি। দেখেছি, ব্যক্তিগত স্তরে মানুষটা খুব সাদাসিধে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:২৯
Share:

প্রশ্ন: গত দশ বছরে আপনার সঙ্গে যত বার কথা হয়েছে, প্রতি বারই কোনও না কোনও প্রসঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথা এসেছে। প্রণববাবু সম্পর্কে আপনার একটা দুর্বলতা আছে, তাই না?

Advertisement

কৌশিক বসু: সত্যিই প্রণববাবু সম্পর্কে একটা দুর্বলতা রয়েছে। তাঁর অসুস্থতার খবরে আমার কতটা মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, বলে বোঝাতে পারব না।

তবে, তুমি যে দুর্বলতার কথা বলছ, সেটা কিন্তু গোড়া থেকে ছিল না। আমি যে আড়াই বছর ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছি, সেই সময়টায় প্রণববাবুকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তার আগে বড় জোর দু’এক বার সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে, কিন্তু মানুষ হিসেবে তাঁকে একেবারেই চিনতাম না। ২০০৯ সালে আমি মনমোহন সিংহের কথায় কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দিই। রাজনীতির দুনিয়ায় ডক্টর সিংহ কখনও সম্পূর্ণ স্বস্তি বোধ করতেন না। প্রণববাবু ঠিক উল্টো— একদম পোড়খাওয়া রাজনীতিক। প্রথম কয়েক মাস আমার এতে বেশ অস্বস্তি হত। মনে আছে, এক দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বললাম, আমি ভারতে এসেছি নীতিনির্ধারণের কাজ করব বলে— এত রাজনীতিতে আমার বেশ অসুবিধা হচ্ছে। ডক্টর সিংহের কাছে কথাটা যে ভাবে বলেছিলাম, তাতে হয়তো প্রণববাবুর প্রতি অভিযোগের একটা সুর প্রচ্ছন্ন ছিল। প্রধানমন্ত্রীর উত্তরটা এখনও আমার কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, প্রণববাবু আছেন বলেই তিনি নিজের কাজটুকু করতে পারেন। মিডিয়ায় যা-ই লেখা হোক না কেন, তিনি ব্যক্তিগত ভাবে প্রণববাবুর অতি ঘনিষ্ঠ। সত্যি, প্রণববাবুর প্রতি দিনের অনেকখানি সময় রাজনীতির পিছনে যায়, কিন্তু সে কারণেই মনমোহন বিভিন্ন নীতিনির্ধারণের কাজে অনেক বেশি সময় দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন প্রণববাবুকে এ ভাবেই দেখতে। সে দিন থেকে প্রণবদাকে অন্য ভাবে দেখতে শুরু করি।

Advertisement

যত দিন গিয়েছে, ততই তাঁকে চিনেছি। দেখেছি, ব্যক্তিগত স্তরে মানুষটা খুব সাদাসিধে। অতি সাধারণ জীবনযাত্রায় খুশি। রাজনীতির বিভিন্ন মারপ্যাঁচ তিনি খেলেছেন, কিন্তু তার প্রধান কারণ, দেশ সম্বন্ধে তাঁর যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তা পূরণ করার জন্য। এ ভাবে দেখলে মনে হয়, তাঁর মধ্যে একটা বাস্তবানুগ দার্শনিকতা ছিল। জানো, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র কার্যত মুখস্থ ছিল প্রণবদার।

প্র: এক বার বলেছিলেন, ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার-বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটা বৈঠকে আপনাকে প্রণববাবুর থেকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়েছিল।

উ: ২০১০ সালের ৭ অক্টোবর। দিনটা আমার পক্ষে ভোলা অসম্ভব। ওয়াশিংটনে আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের বার্ষিক বৈঠক— প্রণববাবু আর দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থমন্ত্রী প্রবীণ গোবর্ধন মঞ্চে বক্তৃতা করছেন, আরও গোটাকয়েক উন্নয়নশীল দেশের অর্থমন্ত্রী আছেন মঞ্চে। শ্রোতার আসনে গোটা দুনিয়ার বিশেষজ্ঞরা। আমিও শুনছি। কিছু ক্ষণ পরে প্রণববাবুকে কোনও একটা জরুরি কাজে বেরিয়ে যেতে হল। তাঁর সহকারী এসে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি মঞ্চে তাঁর জায়গায় বসব? তখনও আমি সরকারি দুনিয়ায় নতুন— বেশ আগ্রহের সঙ্গেই মঞ্চে উঠলাম। আমার কী করা উচিত, কিছুই জানি না। চুপচাপ শুধু শুনব, না কি অন্য অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে আমিও নিজের মতামত পেশ করব, এই সব ভাবছি। তার পর ঠিক করলাম, কিছু ক্ষণের জন্য আমিই অর্থমন্ত্রী হয়ে যাই। দুনিয়ার আর্থিক অবস্থা নিয়ে বেশ গুছিয়ে বক্তৃতা করলাম। শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়ায় মনে হল, তাঁদের পছন্দই হয়েছে। আমার বক্তব্য যখন শেষের দিকে, তখন আমার মোবাইলে কলকাতা থেকে একটা ফোন এল। ভাগ্নীর নম্বর। ওখানে বসে ফোন ধরা অসম্ভব। কেটে দিলাম। আবার এল। আবার কাটলাম। আবার এল। বুঝলাম, কিছু একটা ঘটেছে। একটু পরে বেরিয়ে ফোন করলাম। ও দিক থেকে দুঃসংবাদ— মা মারা গিয়েছেন। প্রণববাবুকে বললাম, আমার মা কিছুই মানতেন না, কিন্তু তাঁর একটাই ইচ্ছে ছিল— আমি তাঁর মুখাগ্নি করি। প্রণবদা বললেন, এখনই চলে যাও। অনেক কাজ পড়ে ছিল ওয়াশিংটনে। অর্থমন্ত্রী সেগুলোকে পাত্তাই দিলেন না।

প্র: প্রণববাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, দিল্লিতে এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাংলার জন্য কিছুই করেননি।

উ: কেন তিনি বাংলার জন্য কোনও বাড়তি সুবিধের ব্যবস্থা করেননি, সেটা আমি বুঝতে পারি। এবং, সেই কারণে আমি তাঁকে সম্মান করি। দেখো, প্রণবদা আদ্যন্ত বাঙালি ছিলেন। বাংলার সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত। ইংরেজির চেয়ে বাংলায় স্বচ্ছন্দ ছিলেন অনেক বেশি। কিন্তু, তাঁর কাজের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিগত পরিচিতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তিনি গোটা দেশের জন্য ভাবতেন। সেখানে ব্যক্তিগত পরিচিতির কারণে কোনও বিশেষ গোষ্ঠীকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কথা তিনি ভাবতে পারতেন না। বস্তুত, এই কথাটা ধর্মের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে সত্যি। প্রণবদা নিজে নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন, পুজো করতেন। কিন্তু সেটা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার— তাঁর কাজের জগতে সেই পরিচিতির গুরুত্ব ছিল না। ধর্ম, জাতি, ভাষা— কোনও পরিচিতিই তাঁর রাজনৈতিক বা পেশাদারি জীবনে প্রভাব ফেলেনি।

বৃহত্তর অর্থ সেকুলার বলতে যা বোঝায়, প্রণবদা ঠিক তা-ই ছিলেন— নেহরুর মতো, স্বাধীন ভারতের আদি পর্বের নেতাদের মতো। স্বীকার করতেই হবে, তাঁর চরিত্রের এই দিকটাকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি। এ ভাবে দেখতে পারাই তো বাঙালি মনীষীদের চরিত্রলক্ষণ ছিল— রামমোহনের, বিদ্যাসাগরের। এই নিরপেক্ষতার জন্যই তো স্বাধীন ভারত, আর্থিক ভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও, সারা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দুর্ভাগ্য, আজ কিছু ভারতীয় দেশের এই শক্তির জায়গাটাকে নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

প্র: ইন্দিরা গাঁধী বিষয়ে কখনও কিছু বলতেন?

উ: বহু বার বলেছেন। ইন্দিরার প্রতি প্রণবদার গভীর শ্রদ্ধা ছিল। এক দিন প্রণবদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইন্দিরা ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচন ডাকলেন কেন? জিতবেনই, এই ওভার-কনফিডেন্স থেকে? প্রণবদা নির্দ্বিধায় বললেন, না। বললেন, ইন্দিরা স্বয়ং তাঁকে বলেছিলেন, নির্বাচনে যে তিনি হারবেন, সেটা তিনি অনুমান করতে পারছিলেন। তার পরও নির্বাচন ডেকেছিলেন একটা অপরাধবোধ থেকে— তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, তাঁর জারি করা জরুরি অবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে পণ্ডিত নেহরুর সবচেয়ে মহৎ উত্তরাধিকারটিকে। ভারতীয় গণতন্ত্রকে। ইন্দিরা নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের পরীক্ষা চেয়েছিলেন।

এ বছর জানুয়ারিতে প্রণবদার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল আমার। তাঁর বাড়িতে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনি নিশ্চিত, হারবেন জেনেও নির্বাচন ডেকেছিলেন ইন্দিরা?” প্রণবদা বললেন, নির্বাচনের আগে ইন্দিরার বলা কথাগুলো এখনও তিনি স্মৃতি থেকে অবিকল বলতে পারবেন— ইন্দিরার সেই কথায় ইঙ্গিত ছিল, ভোটারদের মন যে তাঁর প্রতি প্রসন্ন নয়, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন। ১৯৭৭-এর নির্বাচনে ইন্দিরা নিজের সাফল্য সম্বন্ধে রীতিমতো সন্দিহান হয়েও নির্বাচন ডেকেছিলেন।

প্র: প্রণববাবুর স্মৃতিশক্তি শুনেছি প্রখর ছিল...

উ: ফোটোগ্রাফিক মেমরি বলতে যা বোঝায়, তা-ই। ১৯৪৮ সালে ভারতের প্রথম বাজেট থেকে শুরু করে সব বাজেটের খুঁটিনাটি থাকত তাঁর মাথায়। ১৯৫০-এর দশকের নির্বাচনের ফলাফল বলে দিতে পারতেন গড়গড় করে। তাঁর কাছে সেটা এতই স্বাভাবিক ছিল যে, কখনও দেখনদারি করেননি সেই নিয়ে। এক বার ব্রিটেনের চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার জর্জ অসবর্নের সঙ্গে প্রণববাবুর বৈঠক— আমিও উপস্থিত সেখানে— প্রণববাবু ব্রিটেনের বিভিন্ন বাজেটের কথা বলতে শুরু করলেন। বহু আগেকার সব বাজেট। অসবর্ন দৃশ্যত অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন— আমি নিশ্চিত, প্রণববাবু যে সব কথা বলছিলেন, অসবর্ন নিজে সেগুলো জানতেন না!

সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement