ছবি: সংগৃহীত
দু ঃখ কিসে হয়? গুপী গাইন গাহিয়াছিল, শুধু অভাবই দুঃখের কারণ নহে। রাষ্ট্রপুঞ্জও তাহাই বলিল। কেন? এই বৎসরের মানব উন্নয়ন রিপোর্টে প্রকাশ, প্রতি মিনিটে সত্তর জন মানুষ দারিদ্রসীমা পার হইতেছেন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, সন্তানের শিক্ষা কিংবা অসুখে চিকিৎসা, এমন মৌলিক সুবিধাগুলি দরিদ্রতম মানুষের নিকটও অধরা নাই। অনুন্নত দেশগুলিতেও পুষ্টি, শিক্ষা, আয়ুষ্কালে উন্নতি হইতেছে। অর্থাৎ দারিদ্র কমিয়াছে। কিন্তু বাড়িয়াছে অসাম্য। ধনী ও দরিদ্র, ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীনের মধ্যে দূরত্ব আজ ক্ষোভ দুঃখের এক প্রধান কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। দেশে দেশে মানুষ রাস্তায় নামিয়া বিক্ষোভ দেখাইতেছেন। কখনও ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ, কখনও পেট্রলের দাম বাড়িবার, কখনও তাহা কোনও রাজনৈতিক অধিকারের দাবি। কিন্তু, রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে, এই বিশ্বজোড়া বিক্ষোভের মূল কারণ অন্যায় অসাম্যের অভিঘাত। দরিদ্রকে আরও কিছু অর্থ পৌঁছাইলেই এই দুঃখ কমিবে না, কারণ এই অসাম্য রচনা করিয়াছে ক্ষমতা— ‘‘অল্প কিছু মানুষের অনেক ক্ষমতা, বিপুল সংখ্যক মানুষের ক্ষমতাহীনতা, এবং পরিবর্তন দাবি করিবার সম্মিলিত ক্ষমতা।’’ ক্ষমতার বৈষম্যের বিষয়টি সাধারণত রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতির বিষয় বলিয়াই মনে করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে মানব উন্নয়ন রিপোর্টে ‘অসাম্য’ এবং ক্ষমতার তারতম্যকে আলোচনার কেন্দ্রে আনিয়া, রাষ্ট্রপুঞ্জ উন্নয়নের নীতির অনুসন্ধানকে অর্থনীতির পরিসর হইতে টানিয়া আনিল রাজনীতিতে। দারিদ্র, অস্বাস্থ্য, অশিক্ষা কমাইতে কেবল বাড়তি অর্থ বরাদ্দ যথেষ্ট নহে। ‘‘জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত সামাজিক ও রাজনৈতিক বিধিগুলির মোকাবিলা করিতে হইবে’’, বলিতেছে রিপোর্ট।
দারিদ্র যে বহুমাত্রিক, কেবল আয়ের স্বল্পতার দ্বারা যে তাহাকে ব্যাখ্যা করিলে ভুল হয়, এই অন্তর্দৃষ্টির উপরেই মানব উন্নয়নের ধারণা দাঁড়াইয়া আছে। নব্বইয়ের দশক হইতে প্রকাশিত মানব উন্নয়ন রিপোর্টগুলির কেন্দ্রে বরাবরই রহিয়াছে অমর্ত্য সেনের ‘সক্ষমতা’-র তত্ত্ব। তাহার ভিত্তিতেই ‘মানব উন্নয়ন সূচক’ নির্মিত হয়। প্রসূতিমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, অপুষ্টি-অশিক্ষা প্রভৃতির দ্বারা বিবিধ দেশের অবস্থান নির্দিষ্ট হইতে লাগিল। সমালোচনার চাপে বহু দেশ এই সকল বিষয়ে দ্রুত উন্নতির জন্য নানা নীতি লইয়াছে, তাহাতে কাজও হইয়াছে। তীব্র দারিদ্র কমিয়াছে, আয়ু বাড়িয়াছে, স্কুলে নাম লিখাইয়াছে অধিকাংশ শিশু। এইগুলিকে দারিদ্র দূরীকরণে ‘সাফল্য’ বলিয়া প্রচার করিতেছে বহু দেশের সরকার। রাষ্ট্রপুঞ্জ মনে করাইল, মানব উন্নয়নের বিচারে ইহা যথেষ্ট নহে। আজ কেবল পুষ্টি, সাক্ষরতার মতো মৌলিক সক্ষমতায় কুলাইবে না। সাম্য আনিতে জরুরি উচ্চশিক্ষায় সাম্য, ডিজিটাল প্রযুক্তির নাগাল পাইবার সমতা। মেয়েদের সমান ভোটাধিকার যথেষ্ট নহে, প্রয়োজন মেয়েদের ভোটে দাঁড়াইবার সম্ভাবনায় সমতা।
অর্থনীতির প্রথাগত সীমাবদ্ধতা লইয়া অকপট এই রিপোর্ট প্রশ্ন তুলিল, কেবলই দারিদ্র না মাপিয়া অসাম্য মাপিবার নূতন সূচক নির্মাণ প্রয়োজন কি না। তাহার প্রয়োজন অন্য ভাবেও অনুভূত হইল। মানব উন্নয়নের সূচকে কোন দেশের কী স্থান (ভারত এক ঘর উঠিয়াছে), সেটুকুর বাহিরে এই রিপোর্টের আলোচনা হয় নাই। উন্নয়ন শুধু দরিদ্রের মাথাব্যথা নহে, সমগ্র সমাজের কথা। তাই উন্নয়নের কেন্দ্রে আনিতে হইবে অসাম্যকে।