প্রবন্ধ

কাজ, অকাজ এবং কর্মীর আত্মসম্মান

বঙ্গবাসী অনাচারে অভ্যস্ত। কিন্তু গত চার বছরে অবিচার ও পক্ষপাতের গণ্ডি ছাড়িয়ে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে একটা উদ্ভট বেপরোয়া মাত্রা যোগ হয়েছে। শাসনের প্রয়োগে যুক্তি বা সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ধ রুন আপনি ফুটবল খেলেন। এক জায়গায় ম্যাচ খেলতে গিয়ে দেখলেন প্রতিপক্ষ অতি বেয়াড়া, কোনও নিয়মের তোয়াক্কা রাখে না, কেবল ফাউল করে জখম করতে চায়। রেফারিও চরম পক্ষপাতদুষ্ট, তাদের কোনও অপরাধই গ্রাহ্য করে না। এমন অবস্থায় আপনি রাগ করবেন, প্রতিবাদ করবেন, হতাশ হবেন; তবু হয়তো মাটি কামড়ে খেলে যাবেন, দক্ষ খেলোয়াড় হলে দু-একটা গোলও দিতে পারবেন।

Advertisement

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share:

ধ রুন আপনি ফুটবল খেলেন। এক জায়গায় ম্যাচ খেলতে গিয়ে দেখলেন প্রতিপক্ষ অতি বেয়াড়া, কোনও নিয়মের তোয়াক্কা রাখে না, কেবল ফাউল করে জখম করতে চায়। রেফারিও চরম পক্ষপাতদুষ্ট, তাদের কোনও অপরাধই গ্রাহ্য করে না। এমন অবস্থায় আপনি রাগ করবেন, প্রতিবাদ করবেন, হতাশ হবেন; তবু হয়তো মাটি কামড়ে খেলে যাবেন, দক্ষ খেলোয়াড় হলে দু-একটা গোলও দিতে পারবেন।
আর এক জায়গায় গিয়ে গোড়াতেই ঘোষণা শুনলেন, এই প্রতিযোগিতায় খেলার নিয়ম বেবাক পালটে দেওয়া হল: এবার হাতে বল নিয়ে গোলে ছুঁড়ে দেওয়া যাবে। এমন অবস্থায় মেসি-রোনালদোও বলবেন এভাবে খেলা অসম্ভব, রীতিনীতি বলে-কয়ে নস্যাৎ করা হচ্ছে, এটাকে ফুটবলই বলা চলে না।
আমরা বঙ্গবাসীরা যাবজ্জীবন অন্যায়-অনাচারে অভ্যস্ত। কিন্তু পূর্বতন ইতিহাসের সঙ্গে গত চার বছরের তফাতটা যেন এই গোছের। সয়ে-যাওয়া পাহাড়প্রমাণ অবিচার ও পক্ষপাতের গণ্ডি ছাড়িয়ে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে একটা উদ্ভট খেয়ালি বেপরোয়া মাত্রা যোগ হয়েছে। শাসনের প্রয়োগে যুক্তি বা সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, মনে পড়ছে কাফকার কাহিনির কথা।
রাজ্যের অগ্রগণ্য হাসপাতালে কুকুরের চিকিৎসার প্রস্তাব এই অবস্থার রূপক মনে হতে পারে। চিকিৎসায় মর্মান্তিক অবহেলা ও গাফিলতির ইতিহাস নানা রাজ্যের মতো এখানেও চিরাচরিত। চল্লিশ বছর আগে এক রোগীর ড্রিপে মেলে স্যালাইনের বদলে প্রস্রাব। বছর কুড়ি আগে শাসক দলের মিছিলে আটকে একটি অসুস্থ বাচ্চার কলকাতার রাজপথে মৃত্যু হয়। গত বছর এসএসকেএম-এই বেডের পাশে রক্তের ব্যাগ মজুত থাকা সত্ত্বেও সেই রক্তের অভাবে একটি মেয়ে চোখের সামনে মারা যায়। কোনও জমানাতেই এসবের জন্য কেউ দায়িত্ব নেয়নি, শাসকের কণ্ঠে শোনা যায়নি লেশমাত্র উদ্বেগ-অনুশোচনা। তবু বলা চলে এই ঘটনাগুলি অনভিপ্রেত, ঘটেছে (অবশ্যই অমার্জনীয়) অবহেলায়; তার পিছনে কাজ করেছে এক উদাসীন দম্ভ, জনগণের অধিকারের প্রতি অতল অবজ্ঞা। মানুষের হাসপাতালে কুকুরের চিকিৎসার বিধান কিন্তু অজ্ঞাতসারে হতে পারে না। দম্ভটা এখানে একটা নতুন সক্রিয় মাত্রা পাচ্ছে।

Advertisement

এমন বিধানের নজির বিশ্বে কোথাও আছে বলে জানা নেই। রেকর্ড সৃষ্টির সুযোগ ফস্কে গেল: ঘটনাটা ঘটতে পারেনি। মূল প্রশ্ন তবু থেকে যায়: কিছু প্রবীণ প্রভাবশালী চিকিৎসকের মাথায় এমন ফন্দি এল কী করে? ব্যাপারটা নিয়ে কিছু শোরগোল হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু পাশাপাশি শোনা যাচ্ছে এক কানফাটানো নীরবতা।

নীরবতা তিন স্তরে। প্রথম, ওই হাসপাতালের চিকিৎসকমণ্ডলীর। যে কারণেই হোক, এই বিস্ময়কর অনাচারের বিরুদ্ধে— যা তাঁদের নিজেদের পেশাদারি পরিচয়ের পক্ষে গৌরবময় নয়— তাঁরা সমবেতভাবে একটি কথাও বলেননি। দ্বিতীয় স্তর, রাজ্যের সমবেত চিকিৎসক সম্প্রদায়। সরকারি ব্যবস্থার সঙ্গে তাঁদের অধিকাংশ অবশ্যই যুক্ত নন; সে কারণেই তাঁরা নির্ভয়ে মত প্রকাশ করতে পারেন। তাঁরা উচ্চশিক্ষিত, শ্রদ্ধেয়, এবং যথেষ্ট প্রভাবশালী। তাঁদের নীরবতা সেই শিক্ষা সেই শ্রদ্ধার উপযুক্ত কি না, সে প্রশ্ন তাঁরা নিজেদের কাছে না করলে জনসাধারণ মনে-মনে অবশ্যই করবে। তাতে তাঁদের পসার কমবে না, মান্যতা কমবে। পেশার যে মহত্ত্বের কথা তাঁরা নানা প্রসঙ্গে পাড়েন, সেই মহত্ত্বের তাগিদেই এমন ঘটনায় তাঁদের কাছ থেকে একটা নৈর্ব্যক্তিক নীতিনিষ্ঠ অবস্থান আশা করা অন্যায় নয়।

Advertisement

তৃতীয় স্তরটা আরও ব্যাপক, সেটা বৃহত্তর সমাজের ও কর্মীকুলের। সেই আলোচনার আগে অন্য একটা কথা বলি। এসএসকেএম শুধু হাসপাতাল নয়, উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র। সফল উচ্চশিক্ষার মূলমন্ত্র: চিন্তা ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে একাগ্রতা ও অনুপুঙ্খ শৃঙ্খলা। দুটো চাহিদাই শাসককুলের পক্ষে উপদ্রব। কর্তাদের তাই অভিসন্ধি থাকে, ভারসাম্যটা উল্টে চিন্তা ও বাকস্বাধীনতা যথাসাধ্য রোধ করা; তাতে লেখাপড়া কাজকর্মের ক্ষেত্রে মুক্তাঞ্চল ঘোষিত হলে পরোয়া নেই। কুকুরের আস্ফালন সইবে, মানুষে যেন মুখ না খোলে।

অল্প কিছু সরকারি কলেজ বাদ দিলে রাজ্যের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে ডাক্তারি কলেজগুলিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার শিক্ষকরা পুরোদস্তুর সরকারি চাকুরে। শোনা যাচ্ছে, সরকারের শাসানিই তাঁদের ভীতি ও নীরবতার কারণ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষক সরকারি কর্মী নন, তাঁদের বাগে আনা কয়েক ডিগ্রি কঠিন। বিগত ক’ বছর কিন্তু একের পর এক সেই চেষ্টা চলছে। স্বীকার করতেই হয়, শিক্ষকদের প্রতিবাদী ভূমিকা প্রায়ই আবদ্ধ থাকে বন্ধ্যা রাজনীতি ও অন্যায় দাবিতে। কিন্তু যাঁরা মনে করেন, আইন পাল্টে আচরণবিধি জারি করলে শিক্ষাক্ষেত্র হবে মসৃণ সুশৃঙ্খল, তাঁরা মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন। যেমন অতীত তেমন সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বলে, এতে অনাচার ও স্বেচ্ছাচারের পথ খুলে যায় কেবল, রুদ্ধ হয় প্রতিবাদের রাস্তা।

স্বাধীনতার দাবির সারবত্তা রক্ষায় কিন্তু শিক্ষককুলেরও কিছু করণীয় আছে। আগের জমানায় শিক্ষায় অনাচার এসেছে শিক্ষকদেরই একাংশের মাধ্যমে, তাতে স্বাধীনতা খর্ব না হলেও কলুষিত হয়েছে। আজ আরও মৌলিক ভাবে ক্ষতিকারক কিছু পরিবর্তন আসছে শিক্ষককুলকে পাশ কাটিয়ে। তার সবচেয়ে বিধ্বংসী উদাহরণ, মাত্র দু’বছরে রাজ্যের অধিকাংশ কলেজে ভর্তির আসন কেনাবেচা রীতিসিদ্ধ হয়ে উঠেছে, অন্য কোনও ভাবে ঢোকার কথা ভাবতেই পারছে না হবু ছাত্রেরা। এ নিয়ে শিক্ষকসমাজে কোনও প্রতিবাদ এমনকী চর্চা হয়েছে বলে জানি না। এই ছেলেমেয়েদের পাশ দিয়ে শিক্ষকরা কলেজে ঢুকছেন, দু’দিন বাদে এদেরই ক্লাসে পড়াবেন, এদের মুখের দিকে তাকাতে হবে। এই অনাচারে কিন্তু তাঁরাও নীরব ভাগিদার হয়ে পড়ছেন।

যে-কোনও কর্মক্ষেত্রে সুস্থ বাতাবরণ বজায় রাখতে হলে প্রথমেই চাই তার সদস্যদের একটা পেশাগত আত্মসম্মান, প্রফেশনাল সেলফ-রেস্পেক্ট। এটা সততা বা দক্ষতার সমার্থক নয় (হলে সোনায় সোহাগা হত)। এটা একটা বোধ যে কর্মক্ষেত্রে অন্তত আপাতভাবে কতগুলি পন্থা মেনে চলতে হবে, কয়েকটা মৌলিক প্রশ্নে একটা সমর্থনযোগ্য অবস্থান ধরে রাখতে হবে, ‘আমার কাজের রাশ আমারই হাতে’ এই প্রত্যয় অন্তত কিছু মাত্রায় কার্যকর হবে। ব্যাপারটা ঠাট বজায় রাখা বা নিছক ভণ্ডামিতে পর্যবসিত হতে পারে: বহু অযোগ্য ও দুরাচারী কর্মী এই ঠাটের আড়ালে বেঁচে-বর্তে থাকেন। তবু এর একটা মূল্য আছে। এতে কিছু নিয়মনীতি অন্তত আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃত হয়। এক দিকে চক্ষুলজ্জা অন্য দিকে অপকীর্তি ফাঁস সম্বন্ধে ভয় না হোক, একটা অবচেতন সংকোচ থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, ওই পেশার সৎ ও কর্মঠ সদস্যেরা কাজে বল পান, সত্যিই একটা মর্যাদাবোধ লাভ করেন; ফলে ভরসা পান বাড়তি কাজ করতে, কঠোর হতে, ঝুঁকি নিতে। এই আত্মসম্মান উধাও হলে যে সহজাত কাণ্ডজ্ঞান থেকে আমাদের কাজে একটা ন্যূনতম যুক্তি ও সামঞ্জস্য আসে, সেটা উবে যায়। এই হতোদ্যম নিষ্ক্রিয় দশা এক অর্থে দুর্নীতির চেয়েও হানিকর, কারণ এতে খারাপ কাজ পূর্ববৎ চলতে থাকে, ভাল কাজের সম্ভাবনা লোপ পায়। ভালমন্দনির্বিশেষে সকলেই হয়ে পড়েন নিরুৎসাহ, বহিঃচালিত, আজ্ঞাবহ দাস।

যাঁরা বাইরে থেকে এঁদের চালিত করতে চান, তাঁরা অতএব যারপরনাই চেষ্টা করবেন অধীনস্থ কর্মীদের এই আত্মসম্মান কেড়ে নিতে। পুলিশ-প্রশাসনে প্রক্রিয়াটা বহুদিনের সাধনায় প্রায় সিদ্ধিলাভ করেছে। আমরা মেনে নিয়েছি, কোনও ব্যক্তির আসল বা কল্পিত অপরাধের সঙ্গে অভিযোগের বয়ান, সুতরাং দণ্ডবিধির মাত্রার বিন্দুবিসর্গ যোগ থাকার প্রয়োজন নেই। সরকারি সিদ্ধান্তে, এমনকী আইন প্রণয়নে দরকার নেই ন্যায়, যুক্তি বা সঙ্গতির মৌলিক উপস্থিতি। মেনে নিয়েছি কোনও অপকীর্তির ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না: নেতা-আমলারা মুখ খুলবেন না, খুললে যা বলবেন তা গা-ঝাড়া-দেওয়া আলগা মন্তব্য বা নিছক মুখখিস্তি। যদি কিছু ভাল কাজ হয়, তা হবে সেই একই রেটরিকের তাগিদে, যাতে নানা অনাচার সোৎসাহে পালিত হচ্ছে। ফলে বাহ্যিক উন্নয়ন যেটুকু হচ্ছে, তার ছাপ পড়ছে না সামাজিক পরিতৃপ্তি বা মনোবলে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ফল, দরিদ্র দুর্বল শ্রেণির মানুষ একক ব্যক্তিস্তরে আজও প্রায় জমিদারি আমলের মতো অসহায়। তাঁদের প্রাপ্য আদায়ের একমাত্র পথ সমষ্টির জোরে অর্থাৎ রাজনৈতিক দলে ভিড়ে। তাতে অশেষ নতুন হিংসা ও অনাচার জন্ম নেয়, মানুষগুলোর দাসত্ব ঘোচে না।

আজ নতুন করে চিন্তার কথা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, সমাজকল্যাণ প্রভৃতি গঠনমূলক, তথাকথিত মহান কর্মক্ষেত্রেও পেশাগত আত্মসম্মানের অভাব বড় ঘনঘন ফুটে উঠছে। কোনও পেশাতেই নেহাত পরহিতার্থে সমাজসেবার ডাকে বেশি লোকে কাজ করে না, কখনওই করেনি। কিন্তু অনেকেই করেছে জীবিকা অর্জনের পাশাপাশি নিজের কাছে, আপনজনের কাছে সসম্মান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য, আয়নায় নিজের চোখে চোখ রাখার ভরসা পেতে। সেই কাজটা উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে পড়ছে, যেন পরিকল্পিত ভাবেই চেষ্টা চলছে একটা নৈতিক নিষ্ক্রিয়তায় সমাজকে আচ্ছন্ন করতে। সমস্যাটা নৈতিক হলেও নীতিকথা আউড়ে তার সমাধান হবে না; হবে শুধু যদি আমরা কোনও ভাবে কর্মক্ষেত্রে আমাদের আত্মমর্যাদা আঁকড়ে থাকতে পারি।

দান্তের মহাকাব্যে এক শ্রেণির মানুষের কথা আছে যারা অন্তরে মৃত, পাপ-পুণ্যের কোনও বোধই নেই। এরা মোটেই সুখে নেই কিন্তু: স্বর্গ কোন ছার, নরকেও এদের ঠাঁই নেই, এক বিচ্ছিন্ন ছায়ালোকে এদের অতৃপ্ত প্রেতগুলো ঘুরে বেড়ায়। এমন দশায় নিজেদের এনে ফেললে ইহকাল পরকাল দু’দিক দিয়েই আমরা ঠকব।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement