প্রবন্ধ ১

নাগরিক ভারত দেখতে পায় না, চায় না

‘ফিরে এলেন’ রাহুল গাঁধী। ফিরে এলেন কৃষকের কথা বলে। এটা বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। পরিবারের ইমেজের গণ্ডি পেরিয়ে রাহুল সমানেই ‘সাধারণ মানুষ’-এর খোঁজ করেন। তাদের সঙ্গে তাদের মতো করে মিশতে চান। এখানেই তাঁর বৈশিষ্ট্য।রা হুল গাঁধীর রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় একটা কথা প্রথমেই স্পষ্ট করা দরকার। ভারতের রাজনীতিটা এমনই যে রাজনীতিকের ‘নিজের’ রাজনীতি পাল্টে গিয়ে তাঁর ইমেজের রাজনীতিতে পরিণত হয়। যা যা তাঁরা বলেন কিংবা করেন, সেগুলো সব দেখা দরকার হয়ে পড়ে তাঁদের বাহ্যিক স্তরের পারফর্মেন্স হিসেবে।

Advertisement

বদ্রী নারায়ণ

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০০
Share:

অ-চেনা। জনসভায় রাহুল গাঁধী, রামলীলা ময়দান, দিল্লি, ১৯ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই।

রা হুল গাঁধীর রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় একটা কথা প্রথমেই স্পষ্ট করা দরকার। ভারতের রাজনীতিটা এমনই যে রাজনীতিকের ‘নিজের’ রাজনীতি পাল্টে গিয়ে তাঁর ইমেজের রাজনীতিতে পরিণত হয়। যা যা তাঁরা বলেন কিংবা করেন, সেগুলো সব দেখা দরকার হয়ে পড়ে তাঁদের বাহ্যিক স্তরের পারফর্মেন্স হিসেবে। এমনকী অভিনয় হিসেবেও। আর এই জায়গাটাতেই রাহুল গাঁধীর বিশিষ্টতা। কেননা তিনি একেবারে নতুন একটা ঘরানার রাজনীতি তৈরি করছেন এ দেশে: বাস্তববিত্তিক রাজনীতি। পারফর্মেন্স রাজনীতির বদলে নিজের সত্যিকারের চরিত্রের উপর ভর করা একটা রাজনীতি। তাই গ্রামে গ্রামে যখন রাহুল ঘুরে বে়ড়ান, তখন তাঁর ‘বডি ল্যাঙ্গোয়েজ’-এ মনে হয়, যেন তিনি রাজনীতির লোক নন! অন্য নেতারা এই সব সফরে একটা ‘পারফর্মেন্স’ দেন, রাহুল তা দেন না। তিনি বাস্তবটাকে বাস্তবের মতো করেই গ্রহণ করেন।

Advertisement

অর্থাৎ রাজনীতির চিরাচরিত ধারণা থেকে তাঁর ধরনটা আলাদা। ফলে শহুরে মধ্যবিত্ত তাঁর রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে কোনও ভাবে মেলাতে পারে না, বিরক্ত হয়। নাগরিক রাজনীতির চেনা খাঁচাটার মধ্যে আমরা থাকি, তাই রাহুল গাঁধীর বাস্তব-গন্ধী রাজনীতিটাকে আমরা ঘোর অপছন্দ করি। অথচ শহুরে এলিট সমাজ কিংবা এলিট-অধ্যুষিত মিডিয়ার প্রচারের বাইরে বেরোলেই কিন্তু ব্যাপারটা অন্য রকম। মির্জাপুর গ্রামের এক গরিব মুসলিম মহিলার কথাই ধরা যাক। তাঁর ভাই গঙ্গায় ডুবে মারা গিয়েছেন, খবর পেয়ে রাহুল তাঁর বাড়ি যান। ওই মহিলার ভাষায়, ‘অন্য নেতাদের মতো লাগল না ওঁকে। এসে খাটিয়ায় বসলেন। অনেক কথা বললেন। নিজের ভাই-এর মতো কথা বললেন।’ রাহুল কী করেছিলেন জানি না, কিন্তু ওই পরিবারের ওঁকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের মতোই লেগেছিল।

প্রতি দিনের জীবনে রাহুল নিজে সমানেই এই সাধারণ মানুষ-টির খোঁজ করেন। কিন্তু যে ইমেজটা নাছোড়ের মতো তাঁকে তাড়া করে, সেটা মহামহিম নেহরু-গাঁধী পরিবারের মাহাত্ম্য। আমার মনে হয়, এই বিরাট ইমেজের ভারটা নষ্ট করার চেষ্টা রাহুলের সর্বক্ষণের সংগ্রাম। মহাসাগরের মতো ভারতীয় সমাজের স্রোতের সঙ্গে ভাসতে চান তিনি। ভিড়ের মানুষগুলোর এক জন হয়ে উঠতে চান। ২০১১ সালে এক বার উত্তরপ্রদেশের দলিত ইন্টেলেকচুয়ালদের সঙ্গে এক মিটিং করেন তিনি। মিটিং শেষ হলে জনৈক ব্যক্তি বলেন, ‘…আপনিই তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।’ সঙ্গে সঙ্গে রাহুলের পাল্টা অসহিষ্ণু প্রশ্ন: ‘কেন? আপনি কেন চান যে আমি প্রধানমন্ত্রী হই? আমি ইন্দিরা গাঁধীর নাতি আর রাজীব গাঁধীর ছেলে বলে? আমি তো আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই, কাজ করতে চাই। তাতে যেটুকু আমি বলতে পারি কিংবা সাহায্য করতে পারি, সেটুকুই তো আমি চাইছি।’ কংগ্রেস উপ-সভাপতি হওয়ার পরও রাহুল দলের ক্ষমতার প্রতীক থেকে নিজেকে আলগা করে নেওয়ার চেষ্টা করেন। বলেন, ক্ষমতা জিনিসটা বিষের মতো। বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষমতা ছড়িয়ে দিতে পারলে যে ক্ষমতা পাওয়া যায়, সেটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভারতীয় রাজনীতিতে নেতা মানে ‘দয়ালু কর্তা’, ‘মাঈ-বাপ’। রাহুলের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ সামান্যই, বেশিটাই দূর থেকে তাঁকে লক্ষ করা: কিন্তু এর ভিত্তিতেই বলতে পারি, আমার মনে হয়েছে আমি এক জন কমরেড বা বন্ধুকে দেখছি, যিনি তরুণসমাজের সঙ্গে মিশতে চান, ওদের জানতে চান। তাই তিনি যখন সিআইআই-এ গিয়ে বক্তৃতায় বলেন, এমন নেতার প্রত্যাশা করবেন না, যিনি সুপারহিরো-র মতো ঘোড়া ছুটিয়ে এসে আমাদের রক্ষা করবেন, তখন রাহুল ভারতীয় নেতার ধারণাটাকেই প্রশ্ন করে বসেন।

Advertisement

সুপারম্যান নেতার ধারণাটাকে এ ভাবে উড়িয়ে দিয়ে রাহুল ভারতের রাজনীতিতে একটা নতুন গণতান্ত্রিকতা ফিরিয়ে আনছেন বললে তাই ভুল হবে না। কংগ্রেস-এর ‘হাইকম্যান্ড’ রাজনীতিকেও প্রশ্ন করেছেন তিনি। পার্টি টিকিট কাকে দেওয়া হবে সেটা পার্টির উপরতলার বদলে পার্টির তলা থেকে ঠিক করতে চেয়েছেন। বলেছেন, দুই থেকে পাঁচ জন লড়বেন এমপি বা এমএলএ-র টিকিটের জন্য। মানুষই ঠিক করবেন কে টিকিট পাবেন। এমনও বলেছেন যে নির্বাচনী ইশতেহারও মানুষের সঙ্গে কথা না বলে ঠিক করা যাবে না। এক জন সত্যিকারের গণতন্ত্রমনস্ক নেতা যে ভাবে ভাববেন, দেশের গণতন্ত্রকে যে ভাবে দৃঢ় করতে চাইবেন, রাহুল সেটাই বলেছেন।

এই বাস্তবতার রাজনীতি রাহুলের ব্যক্তিত্বেই প্রোথিত। স্পষ্ট কথা বলেন। স্পষ্ট ভাবে নিজের দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেন। উত্তরপ্রদেশের গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় লালকৃষ্ণ আডবাণী বলেছিলেন, এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি রাহুল গাঁধীর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ। সম্প্রতি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রাহুলকে তাঁর খুব আন্তরিক, ‘জেনুইন’, বলে মনে হয়।

আন্তরিক বা ‘জেনুইন’ ব্যাপারটা ঠিক কী? এক জন লোক নিজে সত্যি যা, তেমনটাই দেখানোটাকেই হয়তো জেনুইন বলে। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরিক সত্তার মধ্যে যখন কোনও বিরোধ থাকে না, সেটাই জেনুইন। তা, এই জেনুইন ব্যাপারটাকে কেন ইংরেজি-ভাষী নাগরিক ভারত ততটা পছন্দ করে না? রাহুলও তো সেই ইংরেজিভাষী ভারতেরই সন্তান। মজা হল, তাঁর জেনুইন ভাবটা তাঁর নিজের সমাজের ঠিক পছন্দসই নয়। সাধারণ মানুষের উল্টো দিকে এঁরা অসাধারণ হয়ে থাকাটা পছন্দ করেন। আর সাধারণ মানুষ থেকে সরে থাকলেই ক্ষমতা জিনিসটাকেও বেশি করে লাভ করা যায় বলে ভাবেন। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির কিছু রাজনীতি-সচেতন বন্ধু বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, রাহুল কেন গ্রাম-প্রধানদের সঙ্গে এত কথা বলেন? আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় স্তর হিসেবে গ্রামপ্রধান অনেকটাই নীচু। তাঁদের সঙ্গে রাহুলের মতো নেতার এত কী কথা? কে জানে, রাহুল হয়তো এমএলএ-এমপি কণ্টকিত রাজনীতি থেকে একটু দূরে থাকতে চান।

মনে পড়ে, এক বার একটি সেমিনারে রাহুল যাবেন বলে এসপিজি তাঁর গার্ডদের জন্য আয়োজকদের কাছ থেকে একটা অতিরিক্ত গাড়ি চায়। আয়োজকরা একটি ‘নন-এসি’, বেশ ছেঁড়া-ছেঁড়া সিট-ওয়ালা গাড়ি পাঠান। গাড়িটি দেখেই রাহুল এক লাফে তাতে চ়়ড়ে বসেন। অন্যান্য নেতারাও আর কী করেন, বাধ্য হয়ে নিজেদের ভাল ভাল বিলাসবহুল গাড়ি ছেড়ে রাহুলের সঙ্গে সেই পুরনো গাড়িতেই চড়ে পড়েন। সেমিনারে পৌঁছে রাহুলের মুখে সেই পরিচিত প্রসন্ন হাসি।

অভিজ্ঞতায় দেখেছি, হতদরিদ্র দলিত ও অন্যান্য প্রত্যন্ত গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে মিশবার বিরল ক্ষমতা আছে তাঁর। এলিট বৃত্তেও তিনি সহজ। আর চাটুকারদের সংস্পর্শে? মহা বিরক্ত। সম্প্রতি দিল্লিতে কংগ্রেসের সভায় উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় বহুগুণাকে চাটুকারী মন্তব্যের জন্য সর্বসমক্ষে বিরাট বকুনি েদন রাহুল।

কী করে যেন তিনি জানতে পারেন যে উত্তরপ্রদেশে অন্তত ৫০টি ছোটখাটো দলিত গোষ্ঠী আছে, যারা অতীব অনুন্নত, গণতন্ত্রের দরজা থেকে এখনও বহু মাইল দূরে। রাহুলের ত্বরিত প্রতিক্রিয়া: আমাকে এক্ষুনি তালিকা দিন, আমি এদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। কেবল কথার কথা নয়, দেখা করেই ছাড়েন তিনি। কথা বলেন। কথা বলতে গিয়ে ওই মানুষগুলির কাছে ধমকও খান। ঠিক যেমন খুব চেনা লোককে আমরা ধমকাই, সেই রকম। ব্যাপারটা ঠিক ‘মাঈ-বাপ’ নেতার সঙ্গে প্রজার সম্পর্কের মতো নয়! ‘একটা কিছু করতে হবে যাতে এদের সঙ্গে এক দিনের সম্পর্কেই ব্যাপারটা শেষ হয়ে না যায়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার যাতে এদের সঙ্গে সম্পর্কটা ভেতর থেকে গভীর হয়, যাতে এরা মন খুলে নিজেদের দুঃখ বা আনন্দের কথা বলতে পারে। ভারতে রাজনীতি আছে, কিন্তু গরিব মানুষের কথা শোনার জায়গা খুব কম। আমার একমাত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য, এদের কথা শোনার জন্য নিজের কানদুটি তৈরি করা।’

এই রাহুলকে আমরা চিনি না। কিংবা বড়ই কম চিনি।

ইলাহাবাদে জি বি পন্থ সোশ্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement