ভারতের গ্রামীণ মানুষের একটা বড় অংশ স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রাথমিক সুবিধাগুলো থেকেও বঞ্চিত। এ সমস্যা কেবল ভারতের নয়, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা যথাযথ ভাবে পান না। এর কারণ নিয়ে ভারী ভারী বই লেখা যায়, তবে ঘুরেফিরে যে কথাগুলো আসে, তা হল— চিকিৎসকের ঘাটতি, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি, পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা এবং হাসপাতালের দূরত্বের সমস্যা। গ্রামীণ ভারতে যাঁরা চিকিৎসা করেন তাঁদের আশি শতাংশেরই ডিগ্রি নেই, ‘হাতুড়ে’।
সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, আরও বেশি মেডিক্যাল কলেজ, আরও বেশি ডাক্তার চাই। সরকারের টানাটানি অতিমারিতে বেড়েছে, তাই বেসরকারি পুঁজি চাই। অতএব সরকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মেডিক্যাল শিক্ষা হবে, যেখানে জেলা হাসপাতালগুলো হয়ে উঠবে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের ‘টিচিং’ হাসপাতাল। এই ধারণা থেকেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল (এনএমসি) কলেজ তৈরির নয়া রূপরেখা ঘোষণা করেছে, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলোও আরও নমনীয় হচ্ছে কলেজ প্রতিষ্ঠা ও হাসপাতাল ব্যবহারের শর্তে। মেডিক্যাল কলেজ তৈরির নিয়মকানুন কিছুটা শিথিল করল এনএমসি। জমির পরিমাণ, শিক্ষক নিয়োগের শর্ত, সবেতেই কড়াকড়ি কমেছে। এর ফলে নতুন কলেজ তৈরি হবে, বেশি ডাক্তার তৈরি হবে, গ্রামের গরিব মানুষও পাশ-করা ডাক্তার পাবেন।
তবে, এই সোজাসাপ্টা ধারণাটা নিয়ে যদি একটু তলিয়ে ভাবা যায়, তা হলে বেশ কিছু সমস্যা সামনে আসে। এখন প্রতি বছর এমবিবিএস-এ ভর্তি হচ্ছেন ৭৮,৩৩৩ ছাত্র। এই আসনসংখ্যা ৫০ শতাংশ বাড়াতে পারলেও ঘাটতি মেটাতে পনেরো বছর লেগে যাবে। বস্তুত, তখনও ঘাটতি মিটবে না, কারণ ইতিমধ্যে জনসংখ্যা বাড়বে। আসন বাড়িয়ে যথেষ্ট ডাক্তার জোগানোর সময় হাতে নেই— গ্রামীণ ভারতে অকালমৃত্যুর অনুপাত, মেয়েদের রক্তাল্পতা, শিশুদের অপুষ্টির হারের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়।
তা ছাড়া, ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ালেই কি গ্রামে ডাক্তার বাড়বে? জনসংখ্যা-পিছু চিকিৎসকের যে অনুপাত সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ভারতের পাঁচটি রাজ্য সেখানে পৌঁছেছে। কিন্তু সে সব রাজ্যেও গ্রাম ও শহরে চিকিৎসকদের সংখ্যায় তারতম্য যথেষ্ট। ভারতে আরও বেশি ডাক্তার তৈরি হলেও, তাঁরা পাড়ি দেবেন ইউরোপ, আমেরিকায়।
আর এক জটিল বিষয় হল, প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়ারা কলেজে এক দল শিক্ষকের কাছে শিখবেন, হাসপাতালে আর এক দল চিকিৎসকের কাছে প্রশিক্ষণ নেবেন। দু’টি প্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে? চুক্তির ছোট ছোট শর্তেই ঢুকে থাকে সমস্যার ভূত। আমি নিজে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের বেশ কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখেছি, যেখানে সব পক্ষের সদিচ্ছা সত্ত্বেও, রূপায়ণ ও নজরদারি ব্যবস্থায় ফাঁকের জন্য বহু ভাল প্রকল্প নীরবে শেষ হয়ে গিয়েছে।
তাই, চিকিৎসার ঘাটতি মেটানোর উপায় সন্ধান করে যেতে হবে। একটা উপায়, ডিজিটাল চিকিৎসাকে আরও বিস্তৃত, সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলা। গ্রামের মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া। জাতীয় ডিজিটাল স্বাস্থ্য মিশন তার পথ তৈরি করেছে। কিন্তু নতুন চিকিৎসক তৈরি হবে কী করে?
আমরা দেখছি, বিভিন্ন রাজ্যের সরকার ডিগ্রিহীন গ্রামীণ ডাক্তারদের আধুনিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ করেছে। বৈজ্ঞানিক ও নৈতিক দৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্তের সমস্যা রয়েছে। কিন্তু প্রশিক্ষিত চিকিৎসক তৈরির আর একটা উপায় আছে, যা চিকিৎসক-বণ্টনের অসাম্যকে অনেকটা কমাতে পারে। ভারতে ২.৭ লক্ষ দাঁতের ডাক্তার, ৭.৬ লক্ষ আয়ুর্বেদ, হোমিয়োপ্যাথি প্রভৃতি বিকল্প ধারার চিকিৎসক রয়েছেন, যাঁদের মূল পাঠ্যক্রমের একটা বুনিয়াদি অংশ এমবিবিএস পাঠ্যক্রমের সঙ্গে এক। এঁদের একটি বড় অংশ কার্যত কর্মহীন।
ব্রিটেন-সহ পশ্চিম ইউরোপের নানা দেশে সংক্ষিপ্ত সময়কালে নিবিড় কোর্স করার সুযোগ রয়েছে ডেন্টিস্টদের। এনএমসি ইতিমধ্যেই এমবিবিএস পাঠ্যক্রমে সংস্কার করেছে, সে বিষয়ে উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। বিকল্প চিকিৎসক এবং দাঁতের চিকিৎসকদের জন্য ‘কনডেন্সড কোর্স’ তৈরি করা যায়। বিকল্প চিকিৎসা যাঁরা পড়েন, তাঁদের একটা বড় অংশ গ্রামাঞ্চলের যুবক-যুবতী। তাঁদের অনেকে গ্রামে থাকতে চাইবেন, তার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এঁদের নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম ও প্রশিক্ষণের পরে চিকিৎসায় আনা যায়। তবে, তেমন কোর্স না করিয়েও বিকল্প চিকিৎসকদের অস্ত্রোপচার প্রভৃতি আধুনিক চিকিৎসার ছাড়পত্র দেওয়ার যে চেষ্টা চলছে, সেটা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়।
সব সময়েই নতুন পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে, এমন নয়। তাতে সময় ও সম্পদ, দুটোই লাগে বেশি। যে মানবসম্পদ রয়েছে, তার দক্ষতা বাড়ালে দ্রুত সমাধান পাওয়া যায়। যৌথ উদ্যোগের মডেলের জটিলতায় সময় নষ্ট হয় না। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। প্রায় আট কোটি ডায়াবিটিস-আক্রান্ত মানুষ ক্রমাগত বাড়িয়ে যাচ্ছেন সেই রোগীদের সংখ্যা, যাঁদের এখনই হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচার দরকার (না হলে মৃত্যু হবে), চোখের অস্ত্রোপচার (না হলে অন্ধত্ব আসবে), এবং কিডনির রোগের শেষ পর্যায়ের জন্য ডায়ালিসিস। এই সবই কমানো যায়, যদি আগেই ডায়াবিটিস নির্ণয় হয়, শুগার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর ফলে বিশেষজ্ঞদের উপর চাপ কমবে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত প্রাথমিক চিকিৎসা ও গ্রামীণ পরিবেশের উপযোগী ডিজিটাল প্রযুক্তি। যে বঞ্চনা চলছে গ্রামের মানুষের সঙ্গে, তা-ও কিছুটা কমবে।
স্কুল অব মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আইআইটি (খড়্গপুর)