প্রতিবেশ: উত্তর কলকাতার একটি বাজার। ১৯৯৭
নিত্যানন্দের চোখের সামনে বাজারের চেহারা আর ভাষা যাচ্ছে বদলে। কী আর করে সে? একা একা তো বদল আটকাতে পারবে না। তাই সে দেখছে, আর নিজের পুরনো অভ্যেসের যা কিছু বেশ মানুষ-মানুষ ও সুপ্রাকৃতিক, তা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। সব সময় যে পারছে, তা অবশ্যি নয়। নতুন রকমের বাজারগুলো শীতল। কলকল করে মানুষ নানা রকম বাংলায় সেখানে কথা বলছে, হাঁকডাক করছে— এ দৃশ্য প্রায় অদৃশ্য। দামাদামির বালাই নেই, ‘ফিক্সড প্রাইস’। জিনিসপত্র বাহারি প্যাকেটে। পুরনো বাজারগুলোও নতুনদের দেখাদেখি নিজেদের খানিক বদলে ফেলার চেষ্টা করছে। এই তো সে দিন শেওড়াফুলি বাজারে ঢুকতেই চেনা সব্জিকাকা একগাল হেসে বললেন, ‘‘আজকে কয়েকটা শব্দের ইংরিজি বলে দিয়ে যেয়ো দিকি। লাউ, ঢ্যাঁড়শ, কুমড়ো, উচ্ছে, ঝিঙে, পটল— এইগুলোর। ভাবছি কাল থেকে ইংরিজিতে বাজার বিক্রি করব।’’ কাকা অনেক দিনের চেনা। নিত্যানন্দকে হাফপ্যান্ট পরা বয়স থেকে দেখছে। সে তখন বাবার হাত ধরে বাজারে আসত। তার পর নিত্যানন্দের বাবার বয়স হল। চিরকাল বাংলায় বাজার করে নিত্যানন্দকে বড় করে, একা একা বাজার করার কাবিল করে রক্তে প্রচুর চিনি নিয়ে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। সব্জিকাকারও বয়স হয়েছে, তবে নিত্যানন্দের বাবার থেকে ছোট। নিত্যানন্দের ওপর তার বেশ একটা অধিকারবোধ আছে। চিটফান্ড কেলেঙ্কারির সময় নিত্যানন্দ জিগ্যেস করেছিল, ‘‘কাকা, যায়নি তো কিছু?’’ কাকা এক গাল হেসে বলেছিল, ‘‘আগের বার গিয়েছিল ভাইপো। তখনই শিখেছিলাম টাকা কোথায় রাখতে আছে আর নেই। তাই আর ঠকিনি। তুমি তো আবার আগের বারের কেলেঙ্কারির সময় জন্মাওনি।’’ সেই প্রাজ্ঞকাকা কিনা ইংরেজিতে বাজার বিক্রি করবে! নিত্যানন্দের মন খারাপ হয়ে গেল। না-হয় জিটি রোডের ওপরের বেঙ্গল কোল্ড স্টোরেজ ভেঙে একটা অংশ ‘বিয়েবাড়ির জন্য ভাড়া দেওয়া হয়’, অন্য অংশে পাড়ার ইংলিশ মিডিয়াম ‘সেক্রেড হার্ট’ চলে। তাই বলে সব্জিকাকা ‘ফ্রেশ পামকিন, ফ্রেশ পামকিন’ বলে সকালবেলার শেওড়াফুলি বাজারে হাঁক পাড়বে! এ ধর্মে সইবে না। কথায় বলে পরধর্ম ভয়াবহ। নিত্যানন্দ তবু সব্জিকাকাকে নিরাশ করল না। বলল, ‘‘ফিরে এসে বলছি।’’
বোশেখ মাস। ঠা-ঠা রোদ্দুর। বাজারে আজকাল দু’রকম লঙ্কা। এক রকমের লঙ্কা ঢেলে বিক্রি হয়। তারা বেঁটে মোটা। চকচক করছে তাদের গায়ের সবুজ। যেন মোমঘষা গাল। আপেল নয় এই যা। অন্য প্রকারের লঙ্কা রোগা লম্বা, অমন ‘স্লিপারি সবুজ’ তারা নয়। নিত্যানন্দের মা ‘স্লিপারি সবুজ’ লঙ্কা একদম পছন্দ করেন না। পাখি পড়ার মতো শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘‘মোটা, বেঁটেগুলো একদম নিবি না।’’ লঙ্কামাসি বলল, ‘‘ছেলে, লঙ্কাটা ক্যারিতে ভরে দিচ্ছি।’’ নিত্যানন্দের বাবা চিরকাল লঙ্কা নিতেন কাগজের ঠোঙায়। ঠোঙায় না নিলে বাজারের ব্যাগে লঙ্কা ছড়িয়ে যায়। বাজার ঢালার পর তাদের একঠাঁই করা ঝকমারি। তো, ঠোঙা বিষয়টা ক্রমশই উঠে যাচ্ছে। সে সব খবরের কাগজের ঠোঙা। ছোটবেলায় হামেশাই হত, কিছু একটা কিনেছে, ঠোঙা ভর্তি জিনিস নিয়ে বাড়ি ফিরল। মা যখন ঢেলে রাখছে তখন হয়তো ঠোঙার গায়ে কিছু একটা পড়ার মতো লেখা চোখে পড়ল। ঠোঙা খুলে সেটা পড়ে ফেলা চাই। বাবার সঙ্গে মাসকাবারির দোকানে গিয়ে নিত্যানন্দ দেখত ঠোঙায় জিনিস ভরা। ছোট ছোট জিনিস ঠোঙায় ভরে কী দ্রুত সুতলি বাঁধত দোকানি। মুদির দোকানের আংটায় একটা সুতলির গোল্লা ঝোলানো থাকত। সেটা থেকে সুতো টেনে চোখের পলকে ঠোঙায় ভর্তি তেজপাতা, পোস্ত, ডাল টকটক করে খানিকটা দূরে প্রায় ছুড়ে ছুড়ে রেখে দিত। নিত্যানন্দ কায়দা আর গতি দেখে থ। এখন ঠোঙার লেখা পড়াই হয় না, সুতলি বাঁধার সেই মেশিনের মতো হাতও আর নেই। সুতলির বদলে লাল-নীল রবার ব্যান্ড। গরমে চ্যাটচেটে হয়ে তারা গলে যায়। ঠোঙার বদলে এসেছে ‘ক্যারি’। ‘‘কী গো ছেলে কী ভাবছ?’’ মাসির ডাকে নিত্যানন্দের ঘোর ভাঙে। ‘‘ভাবছিলাম কাগজের ঠোঙা রাখলেই তো পারো।’’ ‘‘কী করব ঠোঙা যে আর পাই না গো। ক্যারি দিয়ে যায়।’’ ‘‘হুম্। কিন্তু ক্যারি তো জমে থাকে।’’ ‘‘এটা ঠিক বলেছ ছেলে। ক্যারি হচ্ছে ভূতের মতো। মরেও মরে না। বর্ষাকালে নর্দমার মুখ আটকে যায়।’’ ফোকলা হাসে লঙ্কামাসি।
বাজারের মুখে পনা ময়রার দোকান। অনেক দিনের। ডেলি প্যাসেঞ্জার আর হাটুরেদের এ হল কচুরি-তরকারির তীর্থস্থল। কড়ায় পড়ছে, ঝুড়িতে উঠছে, শালপাতার ছোট প্লেটে নামছে। দুটো কচুরি, ধোঁয়া ওঠা তরকারি, তার পর জিলিপি কিংবা কিটকিটে মিষ্টি কিছু একটা। খেয়ে জল খেয়ে নিলে পেট অনেক ক্ষণ আর কথা কইবে না। পনা ময়রার দই ভাল। সাদা মিষ্টি দই। সে দইতে চাকচিক্য কম। খানিক ঘরোয়া ও স্বাস্থ্যকর। মা কিনতে বলেছিল। কিনতে গিয়ে দেখে দই ভাঁড়ে নেই। সেখানেও সেই ভূতের মতো ক্যারি, তবে এর চেহারা একটু অন্য রকম। ভূত কি আর এক রকম? ভূত যেমন মামদো, শাঁখচুন্নি, জলার ভূত, তেমনই কালো ক্যারি, সাদা ক্যারি, পাতলা প্লাস্টিকের ফেলে দেওয়ার মতো কৌটো। কালো ক্যারিতে আঁশ জিনিস দেয়— মাছ, মাংস। আর ওষুধের দোকান দেয় স্যানিটারি ন্যাপকিন। বাঙালি এ সব দেখাতে চায় না, কালো দিয়ে ঢাকে। পনা ময়রার দোকানে ভাঁড়ের বদলে এখন পাতলা সাদা প্লাস্টিকের কৌটো। তাতেই দই পেতে রাখা। পাঁচশো এক কিলো যার যা চাই। বার করে দেওয়ার সময় চেপা-যন্ত্রের তলায় রেখে কৌটোর মুখ পলিথিন দিয়ে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ‘সিল’ করে দেওয়া হচ্ছে। ভাঁড়ের দইয়ের শেষটুকু মা চেটে চেটে খেত। সেই শেষ-দইতে ভাঁড়ের গন্ধ। তার পরেও দই ফুরোত না। ভাঁড়ে অল্প একটু জল দিলে তা দই-জল হয়ে যেত। সে জল দেওয়ার পরিমাণটুকুই আসলে সব, জল খুব বেশিও নয় খুব কমও নয়। জল বেশি পড়লে ট্যালটেলে বিস্বাদ, কম পড়লে তা খেয়ে আরাম নেই। মধ্যবিত্তের সংসারে সামঞ্জস্যই লাবণ্য। বড় তৃপ্তি ভরে সে দই-জলটুকু খেয়ে নিত মা। শেষ আর তলানির নিজস্ব স্বাদের অধিকার সে সংসারে কেবল যে মায়েদেরই ছিল। অনেক না-পাওয়ার মধ্যে এই পাওয়াগুলো কেমন করে যেন বাঙালি মায়েরা আবিষ্কার করে নিত।
আবিষ্কার না করলে তারা বেঁচে থাকবেই বা কেমন করে! সমাজ কতটুকুই বরাদ্দ করত তাদের জন্য! সবার বরাদ্দটুকু দিতে দিতে দিন ফুরোত, জিনিস ফুরোত, যেটুকু থাকত তার মধ্যে মিশে যেত এই সব নিজস্ব কারুকাজ। সংসারের যাবতীয় খাদের মধ্যে সেই কারুকাজটুকুই ছিল খাঁটি। অভাবের সংসারে তা দিয়েই মায়েরা মনে মনে বানিয়ে তুলত বেঁচে থাকার একান্ত গহনা। সেই যে গল্পে ছিল এক গরিব বাড়ির মেয়ের কথা। তার বাড়ির খোড়ো চাল ছিল ফুটো। সেখান দিয়ে এসে পড়ত শীতের হিম আর চাঁদের আলো। এক দিন তার সঙ্গে বড়লোকের বাড়ির মেয়ের কথা হচ্ছে। বড়লোক বলছে তার সাতমহলা বাড়ির কথা। শেষে সে মেয়ে বড়লোকের বাড়ির মেয়েকে বললে, ‘‘আমাদের বাড়ির চালের ছটা দেখে চাঁদ নেমে আসে। ঢুকে পড়ে আমাদের ঘরে।’’ বড়লোকের মেয়ে ভাবলে, ‘‘বাবা! না-জানি কী না কী বড়লোক!’’ ভাঁড়ের ভুবনের মায়া প্লাস্টিক জানে না।
পনা ময়রার দোকানের গা দিয়ে যে গলিটা চলে গিয়েছে সেটা গিয়ে পড়েছে গঙ্গার লাগোয়া রাস্তায়। শেওড়াফুলির গঙ্গা ডিঙোলেই উল্টো দিকে ব্যারাকপুর। ও লাইনে আগে পাটের কলকারখানাগুলো গমগম করত, অনেক দিন হল নিভে গিয়েছে। শেওড়াফুলি গঙ্গার ঘাটের লাগোয়া কুমোরপাড়া। আগে চাক ঘুরত। তৈরি হত ভাঁড়, জল খাওয়ার মাটির খুরি। বিয়েবাড়িতে লম্বা হাই-বেঞ্চ। পাড়ার কেটারার খাবার দেবে। সট করে বেঞ্চির ওপর রোল করা কাগজ পড়ল। সে কাগজ হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার আগেই টপাটপ মাটির খুরি উল্টে রাখা হল। সাদা পরিচ্ছন্ন কাগজের রোল এ বার উড়ে যাবে না। মাটির জিনিস আর মাটি, দুই-ই জীবন থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। তার বদলে যা আসছে তার অনেক কিছুই বড্ড দেখনদার। দেখায়, চকচক করে, কিন্তু মাটিতে মিশতে চায় না। মাটির মানুষও ইদানীং বিরল। সবাই কেমন যেন মারমুখী। দেখনদাররা এক সময় চাকচিক্য হারিয়ে উপদ্রবের মতো ইতিউতি জমে থাকে। তাদের চাকচিক্য গিয়েছে, তাদের রূপ অতীত হয়েছে। যা অতীত তা-ই তো ভূত। সে ভূতের ভবিষ্যৎ হল নানা জায়গায় চোরাগোপ্তা জমে থাকা। এই সব ভাবতে ভাবতে নিত্যানন্দ গঙ্গার লাগোয়া রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। সব্জিকাকাকে আজ আর ইংরেজি বলা হল না। কুমোরপাড়ার চাক অনেক দিন উঠে গিয়েছে। গঙ্গার খালের ওপর দিয়ে রাস্তা। পাশেই রেল লাইন। হর্ন বাজিয়ে লোকাল ট্রেন চলে গেল ব্যান্ডেল। গঙ্গার খালের ওপর সেতুর দেওয়ালে লেখা: ‘‘পলিথিনে ফুল ফেলবেন না।’’ কে কার কথা শোনে? বোশেখ মাসের রোদ মেখে চিকচিকে গঙ্গার জল চলেছে, আর চলেছে ‘ক্যারি’র ভেতরে জবা আর গাঁদা। পুজোর ফুল জলে ফেলতে হয়, ভক্তবাঙালি সঙ্গে গঙ্গাকে ফাউতে প্লাস্টিক দিচ্ছে। তা হজম করার ক্ষমতা মানুষেরও নেই প্রকৃতিরও নেই। সভ্যতা ক্রমশই প্লাস্টিকের হাতে চলে যাচ্ছে।
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক