নেহাতই ঘোর কলি, তাহা না হইলে সাক্ষী মহারাজের রথের চাকা মাটি হইতে চার আঙুল উপরে উঠিয়া থাকিত। উত্তরপ্রদেশের এই বিজেপি সাংসদ অতীতেও একাধিক বার মনের কথা মুখ ফুটিয়া বলিয়া খ্যাত হইয়াছেন। মনের কথাগুলি— তাঁহার দল বা সঙ্ঘের অনেকেরই মনের কথার মতো— ভয়ঙ্কর, কিন্তু তাহাতে সত্যবাদিতার মহিমা সমধিক প্রকট হয়। যে কথা অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরেও জনসমক্ষে বলিতে নাই, তেমন কথাও অবলীলাক্রমে প্রচার করিবার মধ্যে চমক আছে বইকি। সম্প্রতি আবার সেই মর্মস্পর্শী সত্যবাদিতার প্রমাণ মিলিল। সাক্ষী মহারাজ সাফ সাফ বলিলেন, তাঁহাদের আশা: আসাদুদ্দিন ওয়েইসির নেতৃত্বে এআইএমআইএম তথা মিম বিহারের পরে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে এবং উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপিকে সাহায্য করিবে। মুসলিম ভোটদাতাদের একাংশের ভোট মিম-এর ঝুলিতে পড়িলে বিজেপি-বিরোধী দলগুলির সমস্যা বাড়ে, এই সত্য বহুচর্চিত। বিহারে সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনেও এই সমস্যার কিছু নজির তৈরি হইয়াছে। স্বাভাবিক ভাবেই ওয়েইসির মতো রাজনীতিকদের তৎপরতা বিজেপির পক্ষে বিশেষ ভাবে সুবিধাজনক। এই তৎপরতায় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের প্রত্যক্ষ প্রেরণা এবং সহযোগিতার যে অভিযোগ উত্তরোত্তর প্রবল হইয়া উঠিতেছে, তাহাও নিতান্ত স্বাভাবিক— বিরোধীদের নাক কাটিয়া আপন যাত্রা মসৃণ করিবার কোনও সুযোগ যে তাঁহারা ছাড়িবেন না, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। ওয়েইসির মতো রাজনীতিকরা অবশ্যই বিজেপির পরম বন্ধু। সাক্ষী মহারাজ এই সত্যটিই বলিয়া দিয়াছেন।
মুসলিম ভোটে ভাগ বসাইয়া বিজেপির সুবিধা করিয়া দিতেছেন— এই অভিযোগ শুনিলেই ওয়েইসি অগ্নিশর্মা হইয়া বলিতে থাকেন, তাঁহার রাজনীতি তিনি করিবেন, মুসলিম স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব অন্যদের ছাড়িয়া না দিয়া মুসলমানদের নিজের হাতে তুলিয়া লইবার জন্য গণতান্ত্রিক নির্বাচনে যোগ দিবেন, এই অধিকার কি তাঁহাদের নাই? অবশ্যই আছে। অধিকার লইয়া প্রশ্ন নাই। অধিকার কী ভাবে প্রয়োগ করিতেছেন, প্রশ্ন তাহা লইয়াই। বিভিন্ন রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রবক্তা বিভিন্ন দল বা জোট ‘মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক’ লইয়া যে রাজনীতি করিয়াছে, তাহা নিশ্চয়ই ক্ষোভের কারণ হইয়া উঠিতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষোভকে সুযোগবঞ্চিত জনসাধারণের সামগ্রিক ক্ষোভের অঙ্গ হিসাবে না দেখিয়া ধর্মপরিচয়ের সঙ্কীর্ণ গণ্ডিতে তাহাকে সীমিত ও সংগঠিত করিলে কেবল সঙ্ঘ পরিবারের বিভাজনের কারবারই লাভবান হয় না, প্রবল হইয়া উঠে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি।
এই রাজনীতির পরিণাম কতটা মর্মান্তিক হইতে পারে, দেশভাগ-লাঞ্ছিত স্বাধীনতার ইতিহাস তাহার প্রমাণ বহন করিতেছে। এই ইতিহাসের ভস্মশয্যা ছাড়িয়া এবং ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ নামক গরলের প্রভাব দূর করিয়া ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়িবার যে অভিযান সাত দশক আগে শুরু হয়, অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর দুর্গম পথে তাহার দিশা নষ্ট হয় নাই। কিন্তু গত কয়েক বৎসরে সঙ্ঘ পরিবারের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার দাপটে ভারততীর্থের মূল ধারণাটিই চরম বিপদের সম্মুখীন। সেই বিপদের নাম ‘হিন্দু রাষ্ট্র’। ঠিক সেই কারণেই ‘মুসলমানের স্বার্থ মুসলমানরাই দেখিবে’— এই চিন্তা এবং তাহার ভিত্তিতে গড়িয়া তোলা নির্বাচনী রাজনীতি ভারতের পক্ষে, তাহার সুস্থ ভবিষ্যতের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। সাক্ষী মহারাজ ও ওয়েইসি আপাতদৃষ্টিতে বিপরীত শিবিরে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁহারা এই এক বিপদের প্রতীক। স্বাধীনতার সাত দশক পরে দ্বিজাতিতত্ত্বকে ফিরাইয়া আনিয়া ভারততীর্থে প্রতিষ্ঠা করাই এই দুই শিবিরের প্রকৃত লক্ষ্য। তাঁহারা পরস্পরকে ধন্যবাদ দিবেন, স্বাভাবিক।