মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
নতুন বছরের সূচনা হল। হ্যাপি নিউ ইয়ার। বড় দিন থেকে শুরু করে বর্ষবরণের উৎসব চলছে পুরোমাত্রায়। আলোকধারায় ভেসে যাচ্ছে পার্ক স্ট্রিট। চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়ায় জমজমাট ভিড়। জেলায় জেলায় হরেক রকম মেলা, খেলা, অনুষ্ঠান, পিকনিক ইত্যাদি তো আছেই। এই উৎসবময়তা চলবে আরও কয়েক দিন।
আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় এসে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে শীতের এই মরশুমটিকে বাৎসরিক পার্বণের গরিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আক্ষরিক অর্থেই তাঁর ‘প্রেরণা’য় ক্রিসমাস থেকে নিউ ইয়ার এখন বাঙালির বাৎসরিক উৎসবের ক্যালেন্ডারে বাড়তি গুরুত্ব পায়। কেউ যদি এতে সমালোচনার কাদা ছেটাতে চান, ছেটাতে পারেন। কিন্তু সত্য অস্বীকার করার নয়।
যদিও এ বারের ‘নিউ ইয়ার’ যে খুব আনন্দের মধ্য দিয়ে আসেনি, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ এখনও চলছে। আন্দোলন অগ্নিগর্ভ হয়েছে। পুলিশের গুলিতে জীবনহানির সংখ্যাও কম নয়। চাপে পড়ে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ এখন কী ভাবে প্রায় প্রতি দিন স্ববিরোধী ও উদ্ভট কথাবার্তা বলে চলেছেন, তা-ও সকলেই দেখছেন।
এই রকম একটি আবহে এ রাজ্যের রাজনীতি আগামী দিনে কোন পথে এগোবে এবং তার সম্ভাব্য পরিণাম কী হতে পারে, নতুন বছরের গোড়ায় সেই আলোচনা প্রাসঙ্গিক। বিশেষত, ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের দৌড় শুরু হয়ে যাবে এই বছর থেকেই। ২০২০ সেই দিক থেকে রাজ্য রাজনীতিতে গুরুত্বের বছর।
কয়েক দিন আগে একটি সমাবেশে রাজ্যবাসীর উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছেন, ‘‘আপনারা মন খুলে আনন্দ করুন। ভাবনাচিন্তা সব আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমি যত ক্ষণ আছি, কোনও ভয় নেই।’’ বর্তমান সময়ের নিরিখে কথাগুলি তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে শাসকের আগামী পদক্ষেপের ইঙ্গিত।
বস্তুত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র কাছে ধাক্কা খাওয়ার পরেই তৃণমূলের ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে ওঠে। ২০২১ সালে নির্ধারিত বিধানসভা ভোটে মমতার ভবিতব্য সম্পর্কে আগাম হিসাবনিকাশও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বছর শেষে সিএএ এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা এবং তারই পিছন পিছন তিনটি বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূলের নজরকাড়া জয় ছ’মাস আগের লোকসভার অঙ্ক বদলে দেবে কি না, সেই প্রশ্ন এখন ক্রমে জোরদার হচ্ছে। তাই রাজ্যবাসীর পাশে দাঁড়ানোর এই আশ্বাস যে মমতার ভোট-ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পদক্ষেপ, সেটা বোঝা কঠিন নয়।
আসলে নাগরিকত্বের সঙ্কট কেন্দ্র করে উদ্ভূত এই পরিস্থিতি মমতার পক্ষে সুবিধাজনক। পশ্চিমবঙ্গের মতো সীমান্তবর্তী এবং উদ্বাস্তুসঙ্কুল রাজ্যে বাপ-ঠাকুর্দার কুলজি দিয়ে নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করতে বললে তার প্রতিক্রিয়া কত দূর গড়াতে পারে, সহজেই অনুমান করা যায়। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত থাকতে পারে না। সেই জন্যই বার বার সামনে আসছে অসমের উদাহরণ। যেখানে হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে ১৯ লক্ষ মানুষ ‘নাগরিকত্ব’ প্রমাণের পরীক্ষায় ফেল করে কার্যত ত্রিশঙ্কু হয়ে দিন কাটাচ্ছেন!
মোদী, শাহেরা অসমে নাগরিকপঞ্জি তৈরির পিছনে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের যুক্তি দিয়ে আড়াল খুঁজতে চাইছেন ঠিকই। কিন্তু মূল প্রশ্ন তো সেখানে নয়। আসল কথা হল, নাগরিকপঞ্জি যে ভাবে করার ব্যবস্থা হয়েছে, তাতে বংশ পরম্পরায় এ দেশে বসবাসকারী অসংখ্য লোকের নাম বাদ পড়ার আশঙ্কা ষোলো আনা। অতএব সেই ভীতি অঙ্কুরে নাশ করার দাবিও সঙ্গত। দেশের কর্ণধারেরা কিন্তু এখনও স্বচ্ছ নন। তাঁরা কেউ স্পষ্ট করে বলেননি, নাগরিকপঞ্জির এই উদ্যোগ থেকে তাঁরা সরে আসবেন কি না। এই রাজ্যের বিজেপি তো এখনও রোজ হুমকি দিচ্ছে, এনআরসি হবেই।
বিজেপি-র বাড়ানো এই বলটি লুফে নিয়ে তাঁর নিজের মাঠে ফেলতে মমতা দেরি করেননি। তাতে এ পর্যন্ত তাঁকে অসফল বলা যাবে না। অবস্থাটি তাঁর পক্ষে বরং খানিকটা ‘উইন-উইন’ বলা যেতে পারে। কারণ, মোদী-শাহ যদি নাগরিকত্ব প্রমাণের উদ্যোগে অটল থাকেন, তা হলে প্রতিবাদের হাওয়া মমতা নিজের পালে টানার বাড়তি সুযোগ পাবেন। আর যদি বিজেপি পিছিয়েও যায়, তা হলে সেটা মমতাকে তাঁর ‘আন্দোলনের জয়’ বলে তুলে ধরার পরিসর করে দেবে। রাজ্যবাসীর ‘ভাবনাচিন্তা’ নিজের কাঁধে তুলে নিতে তৃণমূল নেত্রীর আহ্বানও তাতে অর্থবহ হয়ে উঠবে।
কিন্তু সবটাই শাসকের হিসাব মিলিয়ে হবে, তা তো নয়। বিরোধীদের দিক থেকে কৌশল অবশ্যই থাকবে। সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি যার অন্যতম। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ইতিমধ্যেই বিভাজনের তাস খেলেছে। এ নিয়ে তাদের কোনও লুকোছাপা নেই। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে ধাক্কা দেওয়ার নেপথ্যেও তা কাজ করেছে। মমতার বিরুদ্ধে ‘সংখ্যালঘুদের তোষণকারী’ বলে প্রচার একেবারে ‘বিফলে’ যায়নি। বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটের ফলে তার প্রতিফলন নজর এড়ায় না। সেই কৌশল পুরোমাত্রায় জারি থাকবে বলেই মনে হয়।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে নাগরিকত্বের প্রশ্নে এই বিভাজনের রাজনীতি কতটা কার্যকর বা গ্রহণযোগ্য হবে, সেটাও ভাবার। কারণ নাগরিকত্ব প্রমাণের পদ্ধতিটি যে হিন্দু, মুসলমান সকলের ক্ষেত্রেই সমান চাপের, অসম তা বুঝিয়ে দিয়েছে। ফলে বিভাজনের পথ কতটা মসৃণ থাকবে, এখনই বলা কঠিন।
বিজেপি-র আস্তিনে আরও যে সব তির রয়েছে, সিবিআই-ইডির তদন্ত তার একটি। আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে নাম জড়ানো তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তৎপরতা এ বার বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়। বিজেপি যে এই ‘রাজনীতিতে’ পটু, তা প্রমাণিত।
লক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে রাজ্যপালের ভূমিকাও। রাজ্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারের মাত্রা বাড়াতে বাড়াতে জগদীপ ধনখড় কত দূর পৌঁছবেন এবং তাঁর দিল্লির নিয়োগকর্তারা তাঁকে দিয়ে কী কী করাবেন, সেটাও এই বছর রাজ্য রাজনীতিতে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সকাল-বিকেল রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে করতে ধনখড় জল ঘোলা করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও সরকার ফেলে দেওয়ার মতো নির্বুদ্ধিতা করা হবে বলে মনে হয় না। তবে রাজ্যপালের রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনকে ভোটের মাস ছয়েক আগে থেকে ‘সক্রিয়’ করে তোলার চেষ্টা হতে পারে বলে অনেকের ধারণা। যদি আদৌ তা হয়, তার একটা নির্দিষ্ট পরিণতি ঘটতে বাধ্য।
তবে তার আগেই কলকাতা-সহ রাজ্যের শতাধিক পুরসভার ভোট। এ বছরের প্রথমার্ধে তা হওয়ার সম্ভাবনা। বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে সেটি হবে মমতার এক বড় পরীক্ষা। যাকে খবরের পরিভাষায় ‘সেমি-ফাইনাল’ বলা হয়। শতাধিক পুরসভার বিস্তৃতি, গুরুত্ব এবং ভোটার-বিন্যাস বিচার করলে এই পুরভোট থেকে বিধানসভা নির্বাচনের কিছুটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে। জনসমর্থন অনেক কিছুর উত্তর দেয়।
গত বছর জানুয়ারিতে লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-বিরোধী জোটের জন্য ব্রিগেডে বিশাল সমাবেশ করেছিলেন মমতা। জাতীয় স্তরে জোট শেষ পর্যন্ত দানা বাঁধেনি। এখন আবার সিএএ-এনআরসি নিয়ে একই ভাবে সব বিরোধী দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়েছেন তিনি। সাড়াও মিলছে।
দেশে সরকার বদলের কোনও পরিস্থিতি আপাতত নেই। তবে একের পর এক রাজ্যে বিধানসভা ভোটে বিজেপি হারছে। প্রবণতাটি নস্যাৎ করার নয়।