বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার।
এই নিয়ে কত বার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন নীতীশ কুমার, কোনও কুইজ় কনটেস্টে সেই প্রশ্ন এলে প্রতিযোগীরা নির্ঘাত মাথা চুলকাবেন। তবে, তার চেয়ে কঠিনতর প্রশ্ন আছে— ফের কত দিন পরে জোটসঙ্গী বদলাবেন নীতীশ? পটনার মহানাট্যে নীতীশের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা কমেছে, সন্দেহ নেই, কিন্তু রাজনৈতিক খেলার প্রতিভা মাপতে বসলে বিশ্বাসযোগ্যতাকে আর কে-ই বা মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহার করেন! ফের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে নীতীশ অন্তত একটি কথা বুঝিয়ে দিলেন— রাজনীতির জোয়ার-ভাটায় ভেসে থাকতে তাঁর জুড়ি নেই।
বিজেপি তলে তলে তাঁর দল ভাঙানোর চেষ্টা করছিল কি না, সেই প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর পাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু তিনি বিপদের অপেক্ষা করেননি, বরং নিজেই এক ধাপ এগিয়ে খেলেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকার ক্ষমতাই নীতীশ কুমারকে আলাদা করেছিল। তাঁর রাজনৈতিক উত্থান জয়প্রকাশ নারায়ণ-সত্যেন্দ্র নারায়ণ সিংহের হাত ধরে, জনতা আন্দোলনের মাধ্যমে। সেই উত্তরাধিকার তিনি বজায় রেখেছেন, কিন্তু জনতা-পর্বের ফসল অন্য রাজনীতিকদের থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্বতন্ত্র ভাবে। জাত-পাতভিত্তিক পরিচিতির রাজনীতিতে তিনি আছেন— নিজের কুর্মি জাতিপরিচয়কে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারও করেছেন বিলক্ষণ; কিন্তু সেখানেই না থেমে নিজেকে চিনিয়েছেন উন্নয়নবাবু হিসাবেও। সড়ক, বিজলি, সাইকেল— তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম পাঁচ বছরেই বিহারকে অনেকখানি বদলে দিয়েছিল এই তিন অস্ত্র।
শুরু থেকেই তিনি বিজেপির জোটসঙ্গী ছিলেন, এবং মোদী-ঘনিষ্ঠও বটে। তবে, নরেন্দ্র মোদী নন, তিনি সুশীল মোদী— বিহারের বিজেপি নেতা, নীতীশ কুমার সরকারের দীর্ঘ দিনের উপমুখ্যমন্ত্রী। আজীবন সঙ্ঘ-সদস্য সুশীল মোদীর সঙ্গে নীতীশের বোঝাপড়ার বহু ভিত্তির মধ্যে একটি ছিল নরেন্দ্র মোদীর প্রতি যৌথ অপছন্দও। এনডিএ-র শরিক হয়েও বিহারে নরেন্দ্র মোদীকে দীর্ঘ দিন ব্রাত্যই রেখেছিলেন নীতীশ। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেশ জুড়ে ওঠা মোদী-ঢেউয়ে বিহারে ভেসে গিয়েছিল নীতীশের সংযুক্ত জনতা দল, আগের বারের ২০টি আসন থেকে কমে ঠেকেছিল মাত্র দু’টিতে। সেই বিপর্যয়ের দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন নীতীশ, অবশ্য সিংহাসনে তাঁর পাদুকা রাখতে ভোলেননি।
২০১৫ সালেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সঙ্গে মহাগঠবন্ধন গড়ে ফের মুখ্যমন্ত্রী হলেন নীতীশ। গোটা দেশ ভেবেছিল, বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির একটা নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। সে আশায় অবশ্য জল ঢেলে দিলেন স্বয়ং নীতীশই, ২০১৭ সালে জোট ভেঙে ফের হাত ধরলেন বিজেপির। আরও স্পষ্ট করে বললে, নরেন্দ্র মোদীর। ২০২০ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়ন মডেলের কথা বলেই ভোট চাইলেন। জিতে ফের মুখ্যমন্ত্রীও হলেন বটে, কিন্তু এই দফায় তিনি এনডিএ-র ছোট শরিক— সরকারের নিয়ন্ত্রণের রাশ রইল বিজেপির হাতেই।
বিহারের রাজনীতির লাগাম ক্রমশই তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে যাবে, এই রাজনৈতিক ললাটলিখন লেখা হয়ে গিয়েছিল তখনই। তাঁর সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। এক, নিজের রাজনৈতিক বানপ্রস্থ মেনে নেওয়া; এবং দুই, বিজেপির থেকে এক কদম এগিয়ে থেকে আরও এক বার খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। নীতীশের পাঁচ দশক দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন থেকে যদি কোনও একটি কথা অনুমান করা চলে, তা হলে সেটা এই যে, ময়দান ছেড়ে দেওয়ার লোক তিনি নন।
পরের নির্বাচনে কি তিনিও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী? এই প্রশ্নটা উঠছে, তাও এক যুগ হয়ে গেল। ২০১০-১১ নাগাদ নীতীশ যতখানি জোর গলায় বলতেন যে, তাঁর কোনও সর্বভারতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, তিনি বিহার নিয়েই খুশি, এখন আর তেমন ভাবে বলেন না। ক্ষমতার লোভ তাঁর নেই, সে দাবি করারও উপায় তিনিই রাখেননি। কিন্তু প্রশ্ন হল, তিনি চাইলেও কি দিল্লির কুর্সি তাঁর নাগালে আসবে? রাজনীতি অসম্ভবের শিল্প, কাজেই পৌনে দু’বছরের দূরত্ব থেকে পূর্বাভাস করার কোনও অর্থ নেই। কিন্তু, নীতীশের সামনে অন্তত তিনটি দুরূহ বাধা। প্রথমত, গত পাঁচ বছরে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতার বড়সড় ক্ষতি করেছেন তিনি— ফলে, তাঁকে ভরসা করতে অন্য দলগুলি ইতস্তত করলে অবাক হওয়ার কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, সেই ভরসা করার কথা উঠবে তখনই, যখন নীতীশের হাতে যথেষ্ট সংখ্যক আসন থাকবে। চল্লিশটি আসনের রাজ্য বিহারে জেডিইউ যদি তার এযাবৎ কালের সেরা ফলটিরও পুনরাবৃত্তি করতে পারে ২০২৪-এ, তা হলেও আসনসংখ্যা ২০। আসনসংখ্যার নিরিখে তাঁর চেয়ে এগিয়ে থাকবেন, এমন গোটাচারেক নাম এখনই অনুমান করা যায়। তৃতীয় এবং সবচেয়ে বড় বাধা হল, বিজেপি-বিরোধী অন্য দলগুলিকে তিনি তাঁর নেতৃত্বে আসতে রাজি করাতে পারবেন কি? কাজটা সবার জন্যই কঠিন, কিন্তু নীতীশের জন্য আরও বেশি, কারণ ইউপিএ রাজনীতির সঙ্গে তিনি কার্যত সংযোগহীন— যতই তিনি দেশ জুড়ে পদযাত্রার পরিকল্পনা করুন না কেন।
তবে, অন্যদের চেয়ে এক কদম এগিয়ে থাকার অভ্যাস নীতীশের অনেক দিনের। আস্তিনে কোনও টেক্কা লুকিয়েই তিনি খেলতে নেমেছেন কি না, সেই সংশয়ই আপাতত তাঁর রাজনৈতিক তাৎপর্য বজায় রাখবে।