অর্থনীতিবিদ তথা সমাজকর্মী জঁ দ্রেজ় ও তাঁহার দুই সহকর্মীকে আটক করিবার সপক্ষে বিজেপি শাসিত ঝাড়খণ্ডের পুলিশ যুক্তি দেখাইয়াছিল— অনুমতি ছাড়াই সেই রাজ্যের বিষুণপুরে একটি রাজনৈতিক সভা করিতেছিলেন তাঁহারা। পুলিশের অনুমতি ছাড়া রাজনৈতিক সভা ‘বে-আইনি’ হইতে পারে। আইন সেই ক্ষেত্রে ‘আটক’ করিয়া ‘জিজ্ঞাসাবাদ’-এর অধিকার পুলিশকে দিয়াছে। কিন্তু সেই অধিকার প্রয়োগের আগে পুলিশ প্রশাসনের কিছু প্রাথমিক কর্তব্য থাকে। তাহারা কি সেই কর্তব্য পালন করিয়াছে? জঁ দ্রেজ় বলিয়াছেন, সভাটির জন্য আগাম অনুমতি চাহিয়া তাঁহারা পুলিশ ও জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়াছিলেন, উত্তর আসে নাই। এবং, তাঁহারা রাজনীতিক নহেন, রাজনৈতিক সভার আয়োজনও করেন নাই। গণবণ্টন ব্যবস্থা ও পেনশন সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গ্রামবাসীদের জানাইবার প্রয়োজনেই সভার আয়োজন। এই ঘটনার আগের রাত্রেও এমনই একটি সভা হইয়াছিল ওই গ্রামে। তখন পুলিশ আপত্তি জানায় নাই। সুতরাং সন্দেহ করিবার বিলক্ষণ কারণ আছে যে, তাঁহাদের হেনস্থা করাই ছিল পুলিশের— এবং তাহাদের নেপথ্য-চালকদের— মূল উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য পূরণে আইনকে অজুহাত হিসাবে খাড়া করা হইয়াছে মাত্র।
ইহা যে নিছক সন্দেহ নহে, পুলিশের আচরণেই তাহার সুস্পষ্ট সঙ্কেত আছে। জঁ দ্রেজ় দাবি করিয়াছেন, থানায় তাঁহাদের একটি প্রতিশ্রুতিপত্রে স্বাক্ষর করিতে বলা হইয়াছিল। প্রতিশ্রুতি এই মর্মে যে— সরকারের বিরুদ্ধে তাঁহাদের কোনও অভিযোগ নাই। তাঁহারা স্বাক্ষর করেন নাই। করিবার কোনও সঙ্গত কারণও ছিল না। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিবার, সরকারের নীতি ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইবার অধিকার গণতন্ত্রের একটি আবশ্যিক শর্ত। পুলিশ যদি সেই অধিকার লঙ্ঘনের চেষ্টা করিয়া থাকে, তাহা কেবল বেআইনি নহে, কার্যত সংবিধানবিরোধী। কিন্তু পুলিশের এমন আচরণের অভিযোগ শুনিয়া এই দেশে আজ আর কেহ আশ্চর্য হইবেন না। বর্তমান ভারতে ইহাই দস্তুর। সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলিলেই, সমালোচনা করিলেই, এমনকি প্রশ্ন করিলেই হেনস্থা, আটক, গ্রেফতার, নয়তো দেশদ্রোহীর উপাধি প্রাপ্তি ঘটিতে পারে।
লক্ষণীয়, জঁ দ্রেজ় নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপির সমালোচক হিসাবেই পরিচিত। দরিদ্র মানুষের সুযোগবঞ্চনার প্রতিকারে তিনি দীর্ঘ দিন ধরিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করিয়া আসিতেছেন। সেই দিনের সভাটিরও উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র গ্রামবাসীদের কাছে যাহাতে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য পৌঁছাইতে পারে, সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় সাহায্য করা। মনে রাখা দরকার, ঝাড়খণ্ডে অনাহারে মৃত্যুর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়াছে। অভিযোগ, তাহার পিছনে সরকারি নীতি ও প্রশাসনিক ঔদাসীন্যের বড় ভূমিকা ছিল। এ হেন পরিস্থিতিতে গ্রামবাসীদের ‘খাদ্যের অধিকার’ বাস্তবায়িত করিবার বিষয়ে সচেতন ও সক্ষম করিবার উদ্দেশ্যে সভার আয়োজন হইলে তাহা পরোক্ষে সরকারের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে, বুঝাইয়া দেয় যে, তাহারা সমস্ত দরিদ্রের কাছে প্রাপ্য ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য পৌঁছাইয়া দিতে পারে নাই। লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। প্রচার চলিতেছে। এমন সভা এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষে অস্বস্তির কারণ তো বটেই। সুতরাং, হেনস্থা এবং ভীতি প্রদর্শনের সেই চিরপরিচিত দাওয়াই। ইহা কোনও আপতন নহে যে, ঝাড়খণ্ড বা তাহার প্রতিবেশী ছত্তীসগঢ়ে মানবাধিকার আন্দোলনকে দমন করিবার ভয়াবহ সমস্ত কাহিনি সাম্প্রতিক অতীতে রচিত হইয়া আসিতেছে। এই বিষয়ে বিজেপি সরকারই একা দায়ী বলিলে ভুল হইবে, পূর্ববর্তী কংগ্রেস জমানাতেও তেমন অভিযোগ ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে দেশ জুড়িয়া সংখ্যাগুরুবাদী অসহিষ্ণুতার যে তাণ্ডব চলিতেছে, তাহার পরিপ্রেক্ষিতে এমন ঘটনা দ্বিগুণ উদ্বেগ জাগায়।