প্রতীকী ছবি।
শীত এলেই গ্রামের বাঙালির প্রথমেই স্মৃতিপটে ভেসে উঠে খেজুর গাছের মিষ্টি রস। আবহমান বাংলার চাষিরা সে রসে নিজেকে ডুবিয়ে নেওয়ার নান্দনিক দৃশ্য না দেখলে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য একেবারেই বৃথা।
হেমন্তের ফসল ঘরে ওঠার পর পরই প্রকৃতির মাঝে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করে, সেই শূন্যতার মাঝে এলেই এমন শীত ঋতুর আগমন ঘটে। উত্তরের মৃদু হাওয়াতে ঠান্ডা আমেজ, তা হেমন্ত ঋতুর পরেই যেন অনুভব হয়। শুষ্ক শীতল চেহারা নিয়ে আসে শীত ঋতু। একঘেয়েমি যান্ত্রিকতার জীবনকে অনেক পরিবর্তন এনে থাকে এই শীত ঋতুচক্র। বৈচিত্র্যপূর্ণ গ্রামীণ সংস্কৃতির এমন এই শৈল্পিক ঐতিহ্যের চরম প্রাণোচ্ছ্বলতায় আসলেই ঋতুচক্র বছর ঘুরেই দেখা দেয় বার বার।
হিমেল আবরণ টেনেই উপস্থিত হয় এমন শীত, তার চরম শুষ্কতা, নির্মম রুক্ষতা, পরিপূর্ণ রিক্ততা আবার, বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়েও আসে এমন এই শীত ঋতু। অপর দিকে, এমন শীত ঋতু গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্ব পূর্ণ হয়ে উঠে। তাদের জীবনে শীত বিশেষ করে, তা চাষিদের কাছে ভিন্ন মাত্রায় হাজির হয়। স্বপ্ন আর প্রত্যাশায়, তাদের অনেকখানি খেজুর গাছের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবেই যেন আর্থিক উন্নয়নের বসবাস। চাষির জীবন সংগ্রামে অনেক কষ্টের মাঝেও অনেক প্রাপ্তিই যুক্ত হয়।
বাংলার জনপ্রিয় ‘তরুবৃক্ষ’ খেজুর গাছের সঙ্গে ভূমিহীন চাষি, প্রান্তিক চাষি বা দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষের জন্য এই সময়টা হয় অনেক আনন্দদায়ক। কারণ, গাছই তো চাষির অন্নদাতা। খেজুর গাছের যত্ন-আত্তি না করলে রস মিলবে না। আর রস না মিললে গুড় হবে কী করে! পাটালি না দেখলে যেন ঘুম আসে না চাষির। চাষিরা তাদের মেয়ে কিংবা বউয়ের হাতের কাঁচা সুপারির কচি পান গালে পুরে যেন এক বাঁশের ডালি মাথায় করে রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, কল্যাণী শহরে বা বগুলা, চাকদহ, মাজদিয়া, তেহট্ট, করিমপুরের হাটে যাবেই বা কী করে? পাটালি গুড়ের মিষ্টি-মধুর গন্ধে চাষিরা বিক্রয় করতে না পারলে পেটে ভাতে বাঁচবে কী করে? শীত আমেজেই প্রকৃতির মাঝখান হতে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য চাষিরা যেন চষে বেড়ায়। সকাল, বিকেল এবং সন্ধ্যায় মেঠো পথ ধরে তার বহিঃপ্রকাশে চমৎকার নান্দনিকতার সৃষ্টি কিংবা অপরূপ দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী মাঝে এমন এই দৃশ্য অবশ্যই শৈল্পিকতার নিদর্শন। এ শৈল্পিক আস্থা ও বিশ্বাসকে নিয়ে প্রকৃতির মাঝেই বিশাল আকৃতির এক কুয়াশা চাদরে মুড়ি দিতে হয়। শীতেকালে এ রূপ সৌন্দর্যের আর একটি উপাদেয় সামগ্রী ‘খাঁটি সরিষার তেল’, যা শরীরে মালিশ করে অনেকাংশে ত্বকের খসখসে ভাব ও ঠান্ডা দূর করে। এ ভাবেই তেল মালিশে খেজুর গাছে উঠলে নাকি ঠান্ডা দূর হয়। এই শীতেই শাল, সেগুন, আমলকি, জামরুল, কৃষ্ণচূড়ার বনে লাগে হিমেল হাওয়ার ছোঁওয়া। শীতের এমন বাতাসে রিক্ততার সুর বেজে উঠলেও অনেক চাষির আর্থিক উন্নয়নে জন্য এই শীত ঋতুই প্রিয়।
গ্রামাঞ্চলে খুব ভোরে অর্থাৎ সূর্য উদয়ের আগে, বহু খেজুর গাছ থেকে রসের হাড়ি ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে নামিয়ে আনতে চাষির যেন কোনও প্রকার ক্লান্তি বা অস্বস্তি লক্ষ করা যায় না। রাতের শেষে, কুয়াশার সকালে হিমশীতল রস এমন হাড়কাঁপানি ঠান্ডাতে খাওয়ার স্বাদ একটু আলাদা।
খুব ভোরে রস খেলে শীত আরও জাঁকিয়ে বসে। তবুও এমন শীতে শরীর কাঁপানি ঠান্ডার এক স্পন্দন যেন চরম মজাদায়ক। ভোরের এই প্রকৃতি তখন ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা থাকে। ঠিক তখনই উত্তর দিকের প্রচণ্ড হিমেল হাওয়ায় হাড়ে কাঁপন লাগিয়ে তীব্র শীত এসে জেঁকে বসে। সমগ্র প্রকৃতি সে সময়ে শীতের দাপটেই নির্জীব হয়। শীত লাগে লাগুক না, তবুও রস খাওয়ার কোনও বিরাম নেই। এক গ্লাস, দুই গ্লাস খাওয়ার পরে পরেই কাঁপতে কাঁপতে যেন আরও এক গ্লাস মুড়ি মিশিয়ে মুখে তুলে চুমক দেওয়া কিংবা রোদ পোহানোর যে কী আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শীতের কুয়াশায় গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে খড়কুটোয় আগুন জ্বেলে হাত-পা গরম করে।
আবার, তারা অপেক্ষা করে কখন যে রোদের তেজ প্রখর হবে। ‘রোদ’ পোহানো আরামের সঙ্গে আরও অপেক্ষা, তা হল তাদের প্রিয় খেজুর রস। সে রস আসলে যথা সময়ে হাজির হলে তাদের কাছে যেন আনন্দ উল্লাসের কোনই কমতি হয় না। আবার, যেন গ্রামের অভাবী মেয়েরা রংবেরংয়ের যে সব খেজুর পাতার খেজুর পাটি তৈরি করে তার উপর চলে রস খাওয়ার আসর। উপার্জনের জন্যেই খেজুর পাতা শুকিয়ে তা দিয়েই খেজুর পাটি তৈরি। পরে বিক্রি করে সংসারের কিছুটা অর্থ সংকুলান হয়। দেখাও যায় গ্রামের অনেক পরিবার খেজুর পাটিতে ঘুমানোর কাজে তা ব্যবহার করে। খেজুর পাতা দিয়ে এক ধরনের সাহেবি টুপিও তৈরি হয়। খেজুরের পাতা, ডাল এবং গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। আবার মোরোব্বা তৈরিতেই খেজুর গাছের কাটার ব্যবহার প্রচলিত রয়েছে। এক কথায় বলা যায়, এই খেজুর গাছের পাতার এবং ডাল সে কবর পর্যন্ত ব্যবহার হয়।
শীতের শুষ্কতায় অধিকাংশ বৃক্ষলতা পত্র-পল্লবহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু খেজুর গাছের পাতা শক্ত হওয়ার জন্য ঝরে পড়ে না। তাই খেজুর পাতার বেড়া দিয়ে সেখানে খেজুর রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে। এ শীতে তাদের শরীরে বিভিন্ন রংয়ের শাল, জাকেট, সোয়েটার, চাদর। কারও গলায় মাফলার, কারও মাথায় গরম টুপি পরতে দেখা যায়। গ্রামের খেটেখাওয়া মানুষ তীব্র শীত উপেক্ষা করেই কাজে বের হয়। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে কৃষক লাঙল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে মাঠে যায় এবং জমি চাষ করে ঘরে ফিরেই দুপুর থেকে খেজুর গাছ পরিচর্যা করে রসের হাঁড়ি লাগাতে ব্যস্ত হয়।
চাষিরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান এই গাছ থেকে সেই গাছে। মাটিতে পা ফেলার ফুরসতটুকুও পান না এই মানুষগুলো। শীত আসা মাত্রই খেজুর গাছ তোলার জন্য অনেক আগ থেকেই সকাল-সন্ধ্যায় যেন লেগে থাকে চাষি।
খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়। আর এই গাছ গুলোকে যারা কাটে, তাদেরকে নদিয়ায় শিউলি বা গাছি বলা হয়। তাদের উপস্থিতি ক্রমশ যেন কমতে শুরু করেছে এই সময়ে।
রানাঘাট ভারতী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক