নাগরিকত্বের গুণমানে ক্ষয়
NRC

এখনকার আন্দোলন আসলে পূর্ণ নাগরিকত্ব আদায়ের লড়াই

বেলুড় মঠে বিবেকানন্দের জন্মদিনে নরেন্দ্র মোদী যে কথাগুলো বললেন, অনেক কারণেই সেগুলো আপত্তিকর। অমন জায়গায়, অমন দিনে, নাগরিকত্ব আইনের পক্ষে তাঁর সওয়াল অত্যন্ত অসঙ্গত।

Advertisement

যোগেন্দ্র যাদব

শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

ছবি: সংগৃহীত

বেলুড় মঠে বিবেকানন্দের জন্মদিনে নরেন্দ্র মোদী যে কথাগুলো বললেন, অনেক কারণেই সেগুলো আপত্তিকর। অমন জায়গায়, অমন দিনে, নাগরিকত্ব আইনের পক্ষে তাঁর সওয়াল অত্যন্ত অসঙ্গত। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিকাগো বক্তৃতায় বলেছিলেন, সব দেশ ও সব ধর্মের নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় দানই ভারতের বিশেষত্ব। নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) তার ঠিক বিপরীতে যায়, কারণ তা নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের মুসলিমদের গ্রহণ করতে অরাজি। দ্বিতীয়ত মোদী বলছেন,

Advertisement

সিএএ-র বর্তমান নাগরিকদের সম্পর্ক নেই। ওপর-ওপর দেখলে এটা ঠিক মনে হতে পারে, তলিয়ে দেখলে নয়। কারণ জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) কার্যকর হলে কাগজহীন নাগরিকেরা বিপন্ন হবেন। আর নাগরিকত্ব আইন কথায় যা বলছে, তার চাইতে ‘সিগন্যাল’ দিচ্ছে বেশি। যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, কে বাড়ির মালিক আর কে ভাড়াটে। যেন সীমান্তে ঝুলছে অদৃশ্য বোর্ড ‘মুসলিমের প্রবেশ নিষেধ’— সারা দুনিয়া টের পাচ্ছে, মুসলিমেরা ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

আরও একটা কথা মোদী বেলুড় থেকে বলেছেন— সিএএ কারও নাগরিকত্ব কাড়তে পারে না। এটাকে বলা চলে, অর্ধসত্য, যার ব্যবহারে মোদী খুবই পারদর্শী। তিনি এমন ভাব করছেন যেন কোনও ব্যক্তির নাগরিকত্বের প্রশ্ন তুললে উত্তর হয় ‘হ্যাঁ অথবা না’ দিয়ে। নাগরিক, অথবা নাগরিক নয়। আসলে কিন্তু নাগরিকত্ব কেবল থাকা, না-থাকার বিষয় নয়। তার গুণমানের পর্যায় রয়েছে। এক জন নাগরিক আর পাঁচ জনের সঙ্গে সমান মর্যাদা, সমান অধিকার ভোগ করতে পারছেন কি না, সেটাও নাগরিকত্বের প্রশ্ন। এক নাগরিক নিজের মর্যাদা, অধিকার যত সহজে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন, নাগরিকত্বের মান তত উঁচু।

Advertisement

আমার ধারণা, আপনি যদি এক জন মুসলিম হন, তবে আজ রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহারে নিজের অধিকার আদায় করতে চাওয়ার ঝুঁকি নেবেন না। কাশ্মীরের লোকেরা যে নাগরিকত্ব আইন আসার পর বলেছিলেন, ‘এ বার বাকিরা বুঝবে আমরা কী ভাবে বেঁচে থাকি’, তা এই কারণেই। তাঁরা দীর্ঘ দিন নিজের রাজ্যে বহিরাগতের মতো বেঁচে রয়েছেন। মনে হতে পারে, কেন? সংবিধান তো সব ভারতীয় নাগরিককে সমান অধিকার দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, সংবিধানের বাক্যের মানে কী দাঁড়ায়, তা নির্ধারিত হয় পাড়ার থানায়। এই ‘কার্যকর’ সংবিধান বদলে গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের পুলিশ যে ব্যবহার করছে মুসলিমদের সঙ্গে, একটি সম্প্রদায়কে যেমন ভাবে নিশানা করছে একটা গোটা সরকারি ব্যবস্থা, তা আগে দেখা যায়নি।

দাঙ্গা, রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে গণহত্যা এ দেশে কম হয়নি। উত্তরপ্রদেশের মেরঠে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে, যাতে পঞ্চাশ জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার স্মৃতি এখনও মুছে যায়নি। কিন্তু সে সবই একটা নির্দিষ্ট স্থান-কালে সীমাবদ্ধ ছিল— স্থানীয় ঘটনা, ঘটেছে অল্প সময়ের জন্য। এখন দেখা যাচ্ছে, গোটা দেশে পুলিশ-প্রশাসন ব্যবস্থার পরিকাঠামোর মধ্যে এই হিংসাত্মক প্রবণতা অনুপ্রবিষ্ট হয়ে পড়ছে। উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটকের দাঙ্গায়, বা জেএনইউ ক্যাম্পাসে পুলিশের যে রূপ দেখা গেল, তাতে অনেকেই বলছেন, পুলিশ নিজের ভূমিকা ভুলে যাচ্ছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, এটাই পুলিশের নতুন ভূমিকা। বিজেপির গুন্ডাবাহিনী এবং পুলিশ পরস্পর সঙ্গতি রেখে চলছে। পুলিশ-প্রশাসনে যারাই এমন ভাবে ‘পথে আসতে’ দ্বিধা করছে, রাজি হচ্ছে না, তাদের স্রেফ সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কংগ্রেস মন্ত্রীদের দুঃখ করতে শুনছি যে, আইএএস, আইপিএস অফিসারেরা কেন্দ্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন। রাজ্যের সরকারকে সরাসরি অমান্য করছেন না, কিন্তু সব সময়েই কেন্দ্র কী বলছে, তা মাথায় রেখে কাজ করছেন। অর্থাৎ রাস্তায় নেমে হিংসার ক্ষমতা আর রাষ্ট্রের হিংসার ক্ষমতা, দুটো একযোগে কাজ করছে। এ সব কারণে বিরোধী-শাসিত রাজ্যেও মুসলিমদের নাগরিকত্বের গুণমানে ক্ষয় হচ্ছে।

প্রশাসন যে এত ব্যাপক ভাবে নাগরিকের মর্যাদা লঙ্ঘন, অধিকারভঙ্গ করতে পারছে, তার অন্যতম কারণ মিডিয়াতে বিশ্লেষণ ও সমালোচনার অভাব। সরকারের বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছে, এমন মিডিয়া এখন গোটা সংবাদজগতের বড় জোর দুই শতাংশ। গোটা দুয়েক জাতীয় স্তরের ইংরেজি দৈনিক, আর কয়েকটা খবরের ওয়েবসাইট। বড় বড় কিছু দৈনিক খবরের পাতা থেকে সমালোচনা সরিয়ে দিয়েছে সম্পাদকীয় পাতায়। তবে টেলিভিশনের খবর, মানুষের মধ্যে যা সর্বাধিক আলোড়ন তুলতে পারে, সেখানে সরকারের বিরুদ্ধতা নেই বললেই চলে। এর ফলে এত দিন যা ছিল সাবেক মূলস্রোত সাংবাদিকতা, যা কেবল দুই পক্ষের যুক্তি-তথ্য খতিয়ে দেখে কার কোথায় গলদ সেটুকু তুলে ধরত, তেমন গড়পড়তা রিপোর্টিংও আজ চ্যালেঞ্জ-ছোড়া, চড়া সুরের সাংবাদিকতা মনে হচ্ছে।

সরকারের কথাকে যাচাই করা, মূল্যায়ন করার ঝোঁক কমে যাওয়ার ফলে জনজীবনে মিথ্যাকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা যেন বেড়ে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী কত অনায়াসে বলতে পারছেন, ভারতে ডিটেনশন সেন্টার নেই। নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) বিষয়ে কিছুই চিন্তা করা হয়নি। কাশ্মীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এই কথাগুলো যে অসত্য, তা নিয়ে কার সংশয় আছে? নেতাদের মিথ্যাভাষণ নতুন নয়। নির্বাচনী জনসভায় দাঁড়িয়ে বিপক্ষের উপর মিথ্যা আরোপ কোন নেতা না করেন? কিন্তু প্রশাসনের শীর্ষকর্তা দেশের মৌলিক সঙ্কট সম্পর্কে নিপাট অসত্য বলছেন, এমন দেখা যায়নি। এতেও নাগরিকত্বের হানি হয় না কি?

এর ফলে সমগ্র নাগরিক সমাজেই একটা ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। নাগরিকত্ব আইন পাশ হওয়ার পর প্রথম প্রতিবাদ আসে মুসলিমদের থেকে, যা প্রত্যাশিত। কিন্তু যা আমাকে বিস্মিত করেছে, তা হল এর বিপুল বিস্তৃতি। একই সঙ্গে ভারতের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে মুসলিমেরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন। এ এক বিরল ঘটনা। তেমনই আশ্চর্য, এই আন্দোলন তাঁরা করছেন ধর্মীয় নেতাদের এক পাশে রেখে। ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক সংগঠনগুলি বাধ্য হচ্ছে প্রতিবাদের মঞ্চ তৈরি করে দিতে। বোঝাই যাচ্ছে, এই প্রতিবাদ সিএএ-বিরোধিতাকে অতিক্রম করে অনেক দূরে গিয়েছে। গণপ্রহারে মুসলিমদের মৃত্যুর মিছিল, সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিকমাধ্যমে লাগাতার বিদ্বেষের উদ্‌গিরণ, বাবরি মসজিদ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অন্যায্যতা, সব মনে রেখে তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন। বিশেষত মুসলিম মহিলা, যাঁরা রাজনৈতিক কর্মী নন, একেবারই সাধারণ নাগরিক, তাঁদের অভূতপূর্ব উপস্থিতি এই আন্দোলনকে ঐতিহাসিক মাত্রা দিয়েছে।

বিরোধী দলের নেতাদের কেন এই আন্দোলনে সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না? এক, তাঁরা এখনও ভোটের হিসেব কষছেন। নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করলে ক্ষতি হবে না লাভ, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। দুই, তাঁরা নার্ভাস হয়ে আছেন। তাঁরা আন্দোলনে যোগ দিতে চাইলেও জনতা তাঁদের কী ভাবে গ্রহণ করবে, সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত নন।

আজ যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ মুসলিম নন, বা অসম, ত্রিপুরা, মণিপুরের আদি বাসিন্দারাও নন। নাগরিকত্ব আইনের জন্য বিপদে পড়ার সম্ভাবনা যাঁদের কম, তাঁরাও অকল্পনীয় সংখ্যায় নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করছেন। তাঁদের প্রতিবাদের অভিব্যক্তিতে যে অসামান্য সৃজনশীলতা দেখা যাচ্ছে, তা থেকে বোঝা যায় যে তাঁরা কেবল বিজেপির তৈরি আইনের বিরোধিতা করছেন না, ওই আইনের মাধ্যমে বিজেপি যে সাংস্কৃতিক সঙ্কেত পাঠাতে চাইছে, যা নাগরিকত্বের মর্যাদাহানি করে, ভয় দেখায়, অপমানিত ও প্রতারিত করে, তাকে বাতিল করতে চাইছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement