সূচনা। রাজ্য মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান, ২০ মে ২০১১।
এখনও আমরা বিশ্লেষণ করে উঠতে পারিনি ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল। এর পর পাঁচ বছর কেটে গেল। সংবাদপত্র, শিক্ষিত শ্রেণির অন্যান্য মতপ্রকাশ মাধ্যম, বিশেষত টিভি-র পর্দায় আর বিদগ্ধ প্রবন্ধে একটাই প্রশ্ন উঠতে লাগল এই পাঁচ বছর ধরে: এ কী ধরনের পরিবর্তন? একই অনাচার বা আরও বেশি অনাচার, অনাসৃষ্টির জন্য আমরা তৃণমূল সরকারকে ক্ষমতায় আনলাম? এই সব খেদোক্তির মধ্যে ২০১১’য় ঠিক কী ঘটেছিল, তা আজ আমাদের স্মৃতি ও চিন্তার পিছনে চলে গেছে। ২০১৬-র দ্বিগুণ ধাক্কা শিক্ষিত শ্রেণিকে আরও বিহ্বল করেছে। হয়তো ২০১৬ না ঘটলে ২০১১-র তাৎপর্য বোঝা আরও দুরূহ হত।
ভদ্রজনেরা বললেন, ২০১১-র পরিবর্তন ফাঁকা। অন্তঃসারশূন্য এই পরিবর্তনকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। দুর্নীতি, বাহুবল প্রদর্শন, দান খয়রাতি দিয়ে লোক কিনে নেওয়া— এ সবই ছিল পাঁচ বছরের কাহিনি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেটা বুঝেছে, সাময়িক উন্মাদনা থেকে সরে এসেছে। বাংলা এক বিপর্যয়ের কিনারায় পৌঁছেছিল। ২০১৬ তাকে সুস্থ মানসিকতায় ফিরিয়ে আনবে। ২০১১ নামক দুঃস্বপ্নকে মুছে ফেলা যাবে।
কিন্তু ২০১৬-র ঘটনা শুধু ২০১৬’য় কী ঘটল তা নিয়েই আমাদের ভাবতে বাধ্য করবে না, ২০১১’য় কী ঘটেছিল, সে নিয়েও বিশ্লেষণে উৎসাহ দেবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে পক্ষপাত থাকবেই। অভিজ্ঞতার তারতম্য এবং শ্রেণিচরিত্রভেদ বিশ্লেষণকে এক এক মাত্রায় ঠেলে দিতে বাধ্য। তাই মতের সংঘাত চলতেই থাকবে। এবং শিক্ষিত শ্রেণি ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য কমবে, এ আশা ক্ষীণ।
শুরু থেকে শুরু
পশ্চিমবঙ্গে কায়েম হওয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থাটির অন্তর্জলি যাত্রার শুরু ২০০০-০১ থেকে, যখন রাজ্যে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে গেল, দারিদ্র হ্রাসের হার কমতে শুরু করল, অনাহার-মৃত্যুর পুনরাবির্ভাব ঘটল। এ-ও বোঝা গেল যে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা দিয়ে গণসক্রিয়তা উন্মোচনের সম্ভাবনা শেষের দিকে। একটা বড় কারণ ছিল আশি-নব্বইয়ের দশক জুড়ে চটকল-সহ নানা শিল্পের অধোগতি, শ্রমিক-সংখ্যা ও উৎপাদন সংকোচন এবং শহুরে মধ্যবিত্ত-নির্ভর নগর অর্থনীতি। এতে বাজারের যে সংকোচন ঘটল, তাতে ক্ষুদ্র উৎপাদনভিত্তিক কৃষি আর উপযুক্ত সরবরাহ ক্ষেত্র রূপে কাজ করতে পারছিল না। সংক্ষেপে বলা যায়, দুই মৃত্যু দিয়ে এই অন্তর্জলি যাত্রার প্রকাশ: ভিখারি পাসোয়ান এবং পটু মূড়ার মৃত্যু।
শিল্পসংকট, ক্ষুদ্র জোতভিত্তিক কৃষি উৎপাদন, ক্ষুদ্র উৎপাদনের আরও প্রসার, মাঝারি স্তরের ব্যবসা এবং ফড়ে-দালালদের সংখ্যা বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিয়ত মূল্যবৃদ্ধি, মধ্যবিত্তনির্ভর অর্থনীতির প্রসার, গ্রামীণ ঋণের বোঝা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ওপর একান্ত নির্ভরতা এবং সর্বোপরি বহু শ্রমজীবী মানুষের অনিয়মিত অসংগঠিত দিনযাপন পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে এক কোণে ঠেলে দিয়েছিল, যা থেকে বামফ্রন্ট প্রশাসন বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল বাইরে থেকে যে-কোনও মূল্যে বিনিয়োগ এনে। কৃষকের জমি জবরদখল, নানা অবাস্তব উপায়ে উন্নয়নের চেষ্টা এবং খাদ্যসংকট সম্পর্কে চিন্তাভাবনার অভাব, যা ২০০৭-০৮-এর ‘রেশন বিদ্রোহ’ নামক প্রতিবাদের মূলে, এ সবই বামফ্রন্টের প্রশাসনিক রাজনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিল।
লালগড়, উত্তরবঙ্গের খাদ্য-আন্দোলন, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, রাজারহাট, আয়লা বিপর্যয় এবং খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার অবনতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বাংলায় এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি করল, যা নানা দিক দিয়ে ১৯৬৫-৬৬-র সঙ্গে তুলনীয়। ১৯৬৫-৬৬ থেকে পরবর্তী প্রায় দশ বছর যে গণপ্রতিবাদ চলেছিল, তার অবসান ঘটে জরুরি অবস্থার ঘোষণায়, স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। অন্য দিকে, ২০০১ থেকে নানা প্রতিবাদ, প্রতিঘাত, সংকট এবং দ্বন্দ্বের অবসান বাংলায় এল ২০১১ সালে এক জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
যাঁরা মনে করেন, নাগরিক সমাজের কিছু পদযাত্রার মধ্য দিয়ে নয়া-উদারনৈতিক বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটেছিল, তাঁরা এক দশকের তীব্র সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং সমাজের নিচুতলার শ্রেণিসমূহের অসন্তোষকে লঘু করে দেখেছেন। ২০১১-র নির্বাচন তাই তাঁদের কাছে এখনও এক অকল্পনীয় অঘটন এবং বিফল ঘটনা। এঁরা অনেকেই ৩৪ বছরের বামপন্থী শাসনে লালিত। ষাট-সত্তরের দশকের সামাজিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস এঁদের মনে গভীর রেখাপাত করেনি। এঁরা প্রায় সকলেই বামফ্রন্টের সংঘাতহীন এক মানসিকতার সৃষ্টি এবং স্বাক্ষরবাহী— আমি অন্যত্র যার নাম দিয়েছি বাংলার নিস্তেজ বিপ্লব (প্যাসিভ রেভলিউশন)। সমাজের দ্বন্দ্বে এঁরা বিচলিত হন, নৈরাজ্যের দুঃস্বপ্ন এঁদের তাড়া করে।
নীচের মহল
২০১১ সালে জনপ্রিয়তাবাদী জোয়ারে যে পরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গে এল, ২০১৬-র আয়নায় তার রূপ আজ অনেক পরিষ্কার। রাজ্যের অর্থনীতিতে ব্যাপক অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতি, কলকাতা-সহ নানা নগর শহরের পরিবর্তন, সাবেকি শিল্পের সূর্যাস্তকাল, কৃষকের সংকট, সরকারি ব্যয় সংকোচ-সহ নানা উপাদানের ভিত্তিতে এই জনপ্রিয়তাবাদ গড়ে উঠেছে— যার সামাজিক ভিত্তি সমাজের দরিদ্রতর অংশসমূহের মধ্যে, ম্যাক্সিম গর্কি যার নাম দিয়েছিলেন ‘লোয়ার ডেপ্থ্স’ বা নীচের মহল।
এই নীচের মহলে যেমন শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি আছে, তেমনই আছে নানা ক্লেদ, সংকীর্ণতা, ভবঘুরেপনা এবং ক্রোধ ও হিংসা। পরিচ্ছন্ন শ্রেণিবিভাজন করে ভালটা বেছে খারাপটা সরিয়ে রেখে বামপন্থী কেতাবি রাজনীতি করার সুযোগ নেই। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে জীবন-জীবিকা রক্ষার নিরন্তর প্রয়াস থেকে যে জনপ্রিয়তাবাদের জন্ম, তাতে অমৃত এবং গরল দুই-ই থাকবে।
এক দশক ব্যাপী সামাজিক বিরোধ এবং সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে অসংগঠিত জনসাধারণের যে ইচ্ছা এবং সক্রিয়তা ২০১১’য় দেখা গেছে, তার শ্রেণিভিত্তি এবং সামাজিক অন্তর্বস্তুকে অস্বীকার করলে রাজনৈতিক বিচারবোধ এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া হয় না। কেন জনসাধারণের ব্যাপক অংশ ২০১১’য় তৃণমূলকে সমর্থন করেছিল, কেন এই সরকারের নানা নীতি তার নেত্রী এবং নেতৃত্বকে জনপ্রিয় করেছে, তার অনুসন্ধান না করে ‘গণতন্ত্র বাঁচাতে হবে’ ঘোষণায় এবং বিনাশ-ধ্বংস-নৈরাজ্যের আতঙ্কে বন্দি থাকলে আমরা লোকের প্রহসনের পাত্র হয়ে যাব।
অনিশ্চয়তা এবং আতঙ্ক থেকে স্থিরবুদ্ধি চলে যায়। সে নিয়তি যদি বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণি, বিশেষত বুদ্ধিজীবীদের এড়াতে হয়, তবে গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে কিছু প্রশ্ন ভাবতেই হবে।
কী ভাবে বা কোন যুক্তিতে তৃণমূল এবং হিন্দুত্ববাদীদের সমভাবাপন্ন মনে করা হল? কোন নিরিখে কংগ্রেস তৃণমূল অপেক্ষা অধিক গ্রহণীয় হল? তৃণমূলের সমালোচনায় এ রকম ভারসাম্যহীন দৃষ্টিভঙ্গি এল কী করে, যাতে সদর্থক পদক্ষেপগুলোও স্বীকৃত হল না? সাধারণ মানুষের উপকারে লাগে যে-সব পদক্ষেপ, তাতেও এত ঈর্ষার আবির্ভাব ঘটল কী করে? কেন এই রূঢ় সত্য অস্বীকার করার উদগ্র চেষ্টা, যে, জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির মধ্যে জন-উপাদান, সাধারণ মানুষের জীবনরক্ষার আকাঙ্ক্ষা আছে? কেন মনে হল যে তৃণমূল সরকার ফ্যাসিবাদী, যখন দেখা যাচ্ছে এই সরকার সংখ্যালঘুদের রক্ষা করছে, অভিবাসী (ধরে নেওয়া যাক) বাংলাদেশি শ্রমজীবী মানুষকে নির্যাতনে রাজি হচ্ছে না, উত্তরবঙ্গ দক্ষিণবঙ্গের সাবেকি বিভেদ মেটাতে চাইছে? ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা কী?
এমন নানা প্রশ্ন ভাবতে অস্বীকার করার পিছনে যেমন আছে সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে বামপন্থী দলগুলির অনীহা আর যে-কোনও মূল্যে সরকারে প্রত্যাবর্তনের প্রবল আকুতি, তেমনই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছে হৃত সামাজিক ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তাই প্রথম তরফে সামাজিক অন্তর্বস্তুহীন গণতন্ত্রের ডাক, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে স্বকল্পিত ব্যাখ্যা ও এক রক্ষণশীল সমাজবিজ্ঞানের প্রয়োগ।
কোন সময় থেকে বুদ্ধিজীবী নামক সামাজিক স্তরের মানুষের মনে হল যে তাঁরা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারেন? রাজনীতি, অর্থনীতি, পলিসি, নন্দনতত্ত্ব, বিশ্বচরাচরের সব বোঝেন? তাঁরা জনসাধারণের ব্যাখ্যাতা, তাঁদের ভুল-ঠিকের ঠিকাদার? জাতির বিবেক হয়ে ওঠার এই প্রবণতার জন্ম কবে? রাজনীতিকরা রাজনীতির চর্চা করেন, তাঁরা রাজনীতির কথা বলবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কবে থেকে বামপন্থী রাজনীতিকরা বুদ্ধিজীবী-পরিচালিত হতে শুরু করলেন? আমার ধারণা, এই অহমিকার শুরু আশির দশক থেকে, যখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক সমালোচনাবোধকে ভোঁতা করে দিল। তার ওপর যোগ হয়েছে নয়া উদার নীতি এবং বিশ্বায়নের দৌলতে বুদ্ধিজীবীদের রমরমা। তাঁরা এখন সামাজিক উপদেষ্টা, সাধারণ বোধের ব্যাখ্যাতা, নানা বিষয়ে জ্ঞান আমদানি-রফতানির দায়িত্বে। (চলবে)
সমাজবিজ্ঞানী, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ। মতামত ব্যক্তিগত