মজ্জাগত: পুলিশ ও সাধারণ মানুষ, সবারই মধ্যে বোধহয় রয়েছে ‘ক্ষমতাশালী’দের প্রতি ভয়।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঠিক ২৭ বছর পূর্তির কাকভোরে, এক মহিলার গণধর্ষণ ও খুনের মামলায় অভিযুক্ত চার আসামিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠল। পুলিশের বক্তব্য, অভিযুক্তদের ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রকৃত ঘটনা পুনর্নিমাণের উদ্দেশ্যে। সেখানে অভিযুক্তেরা পুলিশের রাইফেল ছিনিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাই এক রকম বাধ্য হয়েই, এনকাউন্টারে ওদের হত্যা করতে হয়। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, পুলিশ পরিকল্পনা করে, ঠান্ডা মাথায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সাধারণ মানুষও তেমনটাই ভাবছেন এবং সেই কারণেই সোশ্যাল মিডিয়া সহ দেশের প্রায় সর্ব স্তরের মানুষ হায়দরাবাদ পুলিশকে স্যালুট ঠুকছেন। তাঁদের বক্তব্য, ওই অভিযুক্ত চার জনের তো মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য ছিল। তথ্যপ্রমাণ, সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করে সংবিধান নির্দেশিত বিচারব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হলে, অনেক সময় চলে যেত, এবং তার পরেও অভিযুক্ত চার জনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যেত কি না, সন্দেহ। তাই পুলিশ একদম ঠিক কাজই করেছে।
তর্কের খাতিরে ধরা যাক, এই ধারণাটা ঠিক, অর্থাৎ, পুলিশ সত্যিই পরিকল্পিত ভাবে এই চার জনকে হত্যা করেছে। তারা ভাল কাজ করেছে না খারাপ, সেই বিতর্কে না গিয়ে, তারা এমন একটা গুরুতর সিদ্ধান্ত হঠাৎ কেন নিল, সেই দিকটা একটু ভেবে দেখা যাক। একটা বিষয় নিয়ে বোধহয় কেউই দ্বিমত হবেন না, আমাদের দেশের প্রায় সমস্ত রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে না। ভারতের প্রায় সর্বত্রই পুলিশকে চলতে হয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের অঙ্গুলিহেলনে। কেউ যদি একটু সাহস করে নিজের কর্তব্য পালনে তৎপর হন, তাঁকে শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে। ২০১২ সালে আমাদের রাজ্যেই পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণের সত্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে, আইপিএস অফিসার দময়ন্তী সেনের কী পরিণতি হয়েছিল, তা আমরা সকলেই দেখেছি।
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের সর্বত্রই একই অবস্থা। রাজনৈতিক, আর্থিক বা সামাজিক ভাবে প্রভাবশালী মানুষজনের বিরুদ্ধে কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে গেলেই, পুলিশকে নানা ভাবে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক অপরাধের ক্ষেত্রেও এই পরিস্থিতির ব্যত্যয় ঘটে না। সেই কারণে সারা ভারতে প্রতি দিন, দলিত বা হতদরিদ্র মহিলাদের ওপর উচ্চবর্ণের বা ধনিক শ্রেণির তথাকথিত বীরপুঙ্গবদের দ্বারা যে-সব ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সে-সব অভিযোগের অধিকাংশ থানায় নেওয়াই হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দায়ে পড়ে অভিযোগ নেওয়া হলেও, নিগৃহীতা বা তাঁর পরিবারের লোকের প্রতি প্রবল চাপ তৈরি করে বাধ্য করা হয় সেই অভিযোগ তুলে নিতে। আর অভিযোগ না তুলে ন্যায্য বিচারের দাবিতে অবিচল থাকলে, ধর্ষিতা বা তাঁর পরিবারের লোকের কী বীভৎস হাল হয়, সেটা তো আমরা সম্প্রতি ‘উন্নাও’ কাণ্ডে দেখলাম।
তবে প্রভাবশালীদের প্রবল শাসানিতে দগ্ধ হয়েও, কয়েক জন পুলিশকর্তার অন্তত ‘বাজিরাও সিংঘম’ হওয়ার বাসনা একেবারে শুকিয়ে যায় না। সেটারই বোধহয় বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই ধরনের ‘এনকাউন্টার’-এর মাধ্যমে। এ এক বিরল সুযোগ, যেখানে তাদের কাজে বাধা দিতে কোনও নেতা-মন্ত্রী-প্রভাবশালীর চোখরাঙানি নেই। শুধু জনগণের কাছে হিরো হওয়ার বাসনা নয়, এত দিন ধরে নিজের কর্তব্যটুকু পালন করতে না পারার যাতনা-মিশ্রিত অপরাধবোধও হয়তো পুলিশকে এমন একটা কাণ্ড করতে উদ্দীপিত করে তোলে।
এ বার পুলিশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে, তাকানো যাক সাধারণ মানুষের দিকে। প্রতি দিন কাগজে বা টিভির পর্দায় অজস্র ধর্ষণের ঘটনা আমাদের চোখে পড়ে। সে সব ঘটনার অনেকগুলোই কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে যাওয়া দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ড (২০১২), মুম্বইয়ের শক্তিমিল গণধর্ষণকাণ্ড (২০১৩), রানাঘাটের ‘নান’ গণধর্ষণকাণ্ড (২০১৫) ইত্যাদির তুলনায় কম নৃশংস কিছু ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও উপরোক্ত ঘটনাগুলিতে ভারতবাসীকে যে-ভাবে প্রতিবাদ করতে দেখা গিয়েছে, অন্যগুলোর ক্ষেত্রে তেমন স্বতঃস্ফূর্ত ও সামগ্রিক প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ নির্লিপ্তই থেকেছেন। কাশ্মীরের কাঠুয়া বা উত্তরপ্রদেশের উন্নাও কাণ্ডের প্রতিবাদ হয়েছে বটে, তবে সেগুলো মোটেই সার্বিক নয়। একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা এই দুই ক্ষেত্রে প্রায় চুপই থেকেছেন। শুধু তাই নয়, আসিফা গণধর্ষণ ও হত্যার ক্ষেত্রে আবার ধর্ষকদের গ্রেফতারির প্রতিবাদে মিছিলও বেরিয়েছে।
তাই এ সব দেখে বলাই যায়, কোনও ধর্ষণকাণ্ডের প্রতি আমজনতার প্রতিবাদ-বিক্ষোভের তীব্রতা কেমন হবে, বা আদৌ প্রতিবাদ হবে কি না, তা অনেকটাই নির্ভর করে ধর্ষিতা ও ধর্ষকের সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অবস্থানের উপর। দেখা যাচ্ছে, ধর্ষিতার সামাজিক বা অর্থনৈতিক স্টেটাস যদি ধর্ষকের তুলনায় অনেকটা উপরে হয়, এবং ধর্ষকের যদি কোনও রাজনৈতিক পরিচয় না থাকে, তা হলেই কেবল সেই ঘটনায় দেশবাসী সার্বিক ও প্রবল ভাবে প্রতিক্রিয়া জানান। অন্যথায় উদাসীন থাকেন, বা প্রতিবাদ করলেও তার প্রাবল্য কখনওই উচ্চগ্রামের হয় না।
ভেবে দেখুন, দিল্লির নির্ভয়া ছিলেন এক শিক্ষিত সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে, আর তাঁর লাঞ্ছনাকারী ও খুনিরা ছিল সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির কিছু অশিক্ষিত ড্রাইভার বা খালাসি। মুম্বই শক্তিমিলের ধর্ষিতা ছিলেন ফোটোজার্নালিজ়ম-এর শিক্ষানবিশ। আর তাঁর উপর পাশবিক অত্যাচার চালানো লোকগুলো তথাকথিত ‘ছোটলোক’ শ্রেণির। রানাঘাটের ৭১ বছরের বৃদ্ধা খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীর উপর অত্যাচার চালিয়েছিল এক দল ডাকাত। সদ্য ঘটে যাওয়া হায়দরাবাদ কাণ্ডে নির্যাতিতা এক জন পশুচিকিৎসক, আর অভিযুক্তেরা সেই ড্রাইভার বা খালাসি, অর্থাৎ সমাজের চোখে নিচু শ্রেণির মানুষজন। ধর্ষক বা খুনিরা সমাজের হোমরাচোমরা কেউকেটা হলে তেলঙ্গানা পুলিশ যেমন ‘ফেক এনকাউন্টার’-এর রাস্তায় যাওয়ার সাহস দেখাত না, তেমনই আমজনতাও এত তীব্র প্রতিবাদে মুখর হতেন না। কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও, অনেকেই হয়তো ওই তরুণী চিকিৎসকের চরিত্র বা পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন, যেমনটা ঘটেছিল পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে সুজেট জর্ডনের বেলায়।
আসলে আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষের মনের অবস্থা, চেতনে বা অবচেতনে ওই পুলিশকর্মীদের মতোই। এক জন দলিত বা আদিবাসী মহিলা এক জন তথাকথিত উচ্চবর্ণের বা উঁচু শ্রেণির পুরুষের দ্বারা ধর্ষিত হবেন, এটাকে আমরা যেন স্বাভাবিক বলে মেনেই নিয়েছি। তাই হায়দরাবাদ এনকাউন্টারের আগের দিনই উন্নাও-এর আর এক মহাপ্রতাপশালী ধর্ষক জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে নির্দ্বিধায় সদলবলে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্যাতিতার গায়ে পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর সেই জ্বলন্ত শরীর নিয়েই মেয়েটি কয়েক কিলোমিটার ছুটতে থাকে, তার পর প্রায় ৪০ ঘণ্টা হাসপাতালে দুর্বিষহ যন্ত্রণা ভোগ করে শেষে মারা যায়। কিন্তু সেই খবর শুনেও সারা দেশের মানুষ কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ওই মেয়েটার জন্য পথে নেমে আসেন না। বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় মশগুল হয়ে থাকেন তেলঙ্গানা পুলিশের ফেক এনকাউণ্টার নিয়ে আলোচনায়।
সাধারণ মানুষও বোধহয় ওই হায়দরাবাদ পুলিশের মত প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন ধর্ষক খোঁজেন, যাদের সহজে এনকাউন্টার করা যায়। পুলিশ তো আর আকাশ থেকে পড়ে না, আমজনতার ঘরের সন্তানরাই এই পেশায় আসে। সেই প্রাচীন কাল থেকে ক্ষমতাবানকে (তা সে যত খারাপই হোক না কেন) সমীহ করার, ভয় পাওয়ার অভ্যাস আমরা মজ্জাগত করেছি। পুলিশ হই বা আমজনতা, সেই অভ্যাস যাবে কোথায়?