প্রতীকী ছবি।
এক দলিত যুবককে পুড়াইয়া হত্যা করা হইয়াছে, এ-হেন একটি ভয়ঙ্কর সংবাদও এখন প্রথম নজরে ততখানি ভয়ঙ্কর ঠেকে না। বস্তুত, ঘটনাটি যে আদৌ লক্ষণীয়, অনেকেরই মনকে তাহা আলাদা করিয়া মনে করাইয়া দিতে হয়। সেই মনের দোষ? বিলক্ষণ। কিন্তু, জ্যান্ত মানুষ পুড়াইয়া মারিবার মতো প্রবল অস্বাভাবিক ঘটনাকেও যখন মন ‘স্বাভাবিক’ ভাবিতে থাকে, তখন দোষ যদি কাহাকে দিতে হয়, বিবর্তনকে দেওয়া ভাল। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হাতে পড়িয়া ভারত এখন বিপদসঙ্কুল হইয়াছে বটে, কিন্তু এই নীল গ্রহে মানুষের আদি পর্বে বিপদের পরিমাণ ঢের বেশি ছিল। কোনটি রজ্জু, আর কোনটি সর্প, তাহা চিনিতে না পারিলে মারা পড়িবার সম্ভাবনা ছিল ঘোরতর। কোন জিনিসটি ‘স্বাভাবিক’ এবং কোনটি ‘অস্বাভাবিক’, যাহারা সেই বিচার করিতে শিখিয়াছিল, এবং অস্বাভাবিক ঘটনা সম্বন্ধে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বনের অভ্যাস তৈরি করিয়াছিল, বিবর্তনের দৌড়ে তাহারাই টিকিয়াছে। তাহারাই আমাদের পূর্বপুরুষ। তাহার পর পৃথিবী ক্রমে নিরাপদতর হইয়াছে, কিন্তু মনের গঠন পাল্টায় নাই। মন নিরন্তর স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকের বিচার করিতেছে।
কোনও নূতন ঘটনা, বিশেষত তাহাতে যদি বীভৎসতা থাকে, মনের নিকট অস্বাভাবিক ঠেকে। একাধিক প্রক্রিয়ায় তাহা ক্রমে স্বাভাবিক হইয়া উঠিতে পারে— তাহার মধ্যে প্রধানতমটি হইল নিয়মিত ঘটিতে থাকা। দুর্গন্ধ নাকে আসিলে গোড়ায় অস্বস্তি হয়, দম বন্ধ হইয়া আসে। অথচ, খানিক ক্ষণের মধ্যেই সেই গন্ধ এমন ‘স্বাভাবিক’ হইয়া উঠে যে গন্ধটি যে আছে, সচেতন ভাবে তাহাই খেয়াল থাকে না। গন্ধটির নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতিতেও ব্যক্তিগত কোনও ক্ষতি না হওয়ায় মন বুঝিয়া লয়, গন্ধটিতে বিপদ নাই, অতএব তাহা ‘স্বাভাবিক’। সমাজের সর্বাঙ্গ হইতে যে পচা গন্ধটি নিরন্তর বাহির হইতেছে, তাহার কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব এখনও অবধি সিংহভাগ মানুষের জীবনে পড়ে নাই। ফলে, মহম্মদ আখলাককে পিটাইয়া মারিবার ঘটনায় যে মনগুলি নড়িয়া চড়িয়া বসিয়াছিল, একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়া চলা, এবং তাহার প্রত্যক্ষ কোনও আঁচ নিজেদের জীবনে না লাগায় ক্রমান্বয়ে মন বুঝিয়া লইয়াছে, মাঝেমধ্যে এক-আধ জন মুসলমানকে পিটাইয়া মারা স্বাভাবিক। অতএব, তবরেজ় আনসারির গণপ্রহারে মৃত্যু তো অস্বাভাবিক ঠেকেই না, পুলিশ যখন সেই খুনের সহিত যুক্ত এক জনেরও অপরাধ প্রমাণ করিতে পারে না, তখনও তাহা স্বাভাবিক বলিয়াই বোধ হয়। অথবা, কোনও দলিত যুবক যদি উচ্চ জাতের কোনও কন্যার প্রেমে পড়ে, পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে সেই যুবককে খুন করিয়া ফেলাও স্বাভাবিক। কারণ, এই ঘটনা ঘটিয়াই থাকে। বিশেষত, নাগরিক মন যখন দেখে যে এই ঘটনাগুলিতে রাষ্ট্রের, বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির বিশেষ আপত্তি নাই— কার্যত প্রচ্ছন্ন সম্মতি রহিয়াছে— মন তখন তাহাকে আরও বেশি করিয়া স্বাভাবিক বলিয়া মানে।
এই স্বেচ্ছা-সম্মোহন উপকারী বটে। ভারতের সর্বত্র প্রতি দিন যাহা ঘটিতেছে, প্রতিটি ঘটনায় যদি মন যথার্থ প্রতিক্রিয়া জানাইত— রাগিয়া উঠিত, বেদনাহত হইত, প্রতিবাদে ফাটিয়া পড়িত— তবে প্রাত্যহিক কাজকর্ম শিকায় উঠিত। সেই কারণেই, একেবারে প্রত্যক্ষ বিপদ উপস্থিত না হইলে পারিপার্শ্বিক ঘটনাক্রমকে ‘স্বাভাবিক’ তকমা দিয়া মনকে ভুলাইয়া রাখা এক গোত্রের রক্ষণ-কৌশল। যে রাষ্ট্র দমননীতিকেই প্রধান আয়ুধ করিয়া তুলিতে চাহে, তাহার জন্য এই নাগরিক স্বেচ্ছা-অসচেতনতার বাড়া আশীর্বাদ নাই। কাশ্মীর যে গত দেড় মাস কার্যত কারাগারে পরিণত হইয়া আছে, সহনাগরিকদের চোখে তাহা অসহনীয় হইবার কথা ছিল। অথচ, তাহা ‘স্বাভাবিক’ ঠেকিয়াছে, কারণ কাশ্মীরি তথা মুসলমান মাত্রেই দেশদ্রোহী, এবং তাহাদের কঠোর হাতে দমন করাই বিধেয়, এই কথাটি শুধু নিরন্তর পুনরাবৃত্তির ফলে বিশ্বাসযোগ্য হইয়া উঠিয়াছে। দেশের এক প্রান্তে ১৯ লক্ষ মানুষ অনাগরিক ঘোষিত হইলেও অবশিষ্ট দেশ প্রতিবাদ করে নাই, কারণ দেশের নাগরিকের এক অংশের সহিত যে এ-হেন বিমাতৃসুলভ আচরণ করা চলে, সেই কথা শুধু নিরন্তর অনুশীলনের মাধ্যমেই ‘স্বাভাবিক’ করিয়া তোলা গিয়াছে। কাহারও আর তেমন ধাক্কা লাগে না। দাঙ্গাবাজ নেতা হইয়া গেলেও নহে। ধর্ষকের সমর্থনে রাজনৈতিক মিছিল বাহির হইলেও নহে। জাতির জনককে অপমান করিয়া কেহ পার পাইলেও নহে। ভারতীয়দের যথার্থ বিবর্তন ঘটিয়াছে।
যৎকিঞ্চিৎ
মন্ত্রী বললেন, আমি তো জনপ্রতিনিধি হিসেবে এসেছিলাম (অবশ্য তিনিই পরে উপাচার্যের সামনে ‘আমি মন্ত্রী, আমাকে স্বাগত জানাতে এলেন না যে বড়?’ বলে রুদ্রমূর্তি)! রাজ্যপাল বললেন, আমি তো আচার্য তথা অভিভাবক হিসেবে এসেছিলাম! নেতা বললেন, মন্ত্রী তো শিল্পী হিসেবে এসেছিলেন! যিনি আসলে যা, তা বাদে বাকি সব রূপে অকুস্থলে অবতীর্ণ। এমনকি তাঁদের সকলের এক রা: ছাত্রছাত্রীগুলো অমুক দলের ক্যাডার হিসেবে জন্ম নিয়েছিল।