প্রতীকী চিত্র।
ধরা যাউক, নরেন্দ্র মোদীরা যাহা বলিতেছেন, তাহাই ঠিক— বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র লইয়া দুশ্চিন্তার বিন্দুমাত্র কারণ নাই। ধরা যাউক, ইভিএম অদলবদল হইবার যত অভিযোগ উঠিতেছে, সবই ভুয়া। তবু, দেশের হরেক প্রান্তে স্ট্রংরুমের বাহিরে প্রহরারত নাগরিকের ভিড় মিথ্যা নহে। সাধারণ মানুষের উদ্বেগ মিথ্যা নহে যে শেষ অবধি হয়তো তাঁহাদের ভোট গণনাই হইবে না। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই প্রথম বার এমন সুবিস্তৃত অবিশ্বাস মিথ্যা নহে। আজ গণনার শেষে যে ফলই মিলুক, একটি কথা এখনই স্পষ্ট— নির্বাচন কমিশনের উপর নাগরিকের ভরসায় আঘাত লাগিয়াছে। আঘাত সম্ভবত অল্প নহে, বিস্তর। এই পরিণতির দায় বিদায়ী শাসকদের। একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড গুঁড়াইয়া দিয়া তাঁহারা শেষ অবধি দেশকে অবিশ্বাসের তেপান্তরে দাঁড় করাইয়া দিলেন। ব্যর্থতা অবশ্য কমিশনেরও কম নহে। ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় মনে করাইয়া দিয়াছেন, সংবিধান আর কোনও প্রতিষ্ঠানকে এ হেন ক্ষমতা দেয় নাই। সেই অদ্বিতীয় ক্ষমতাও যদি কমিশনের মেরুদণ্ডকে ভরসা না দিতে পারে, তবে কে পারিবে? হৃত আস্থা পুনরুদ্ধার করিতে বহু সাধনার প্রয়োজন। আজিকার কমিশনকে দেখিয়া ভরসা হয় না যে সেই প্রায়শ্চিত্ত করিবার চেষ্টাটুকুও দেখা যাইবে।
স্বাধীন ভারতের তাবৎ নির্বাচন কমিশনের গুণগান করিবার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব কমিশনের উপরই বর্তায়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডুর বক্তব্যেও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বৈধতা রক্ষার কথা বলিয়াছেন। কথাগুলি সব সময়ই জরুরি, কিন্তু গত দেড় মাসের নির্বাচনপ্রক্রিয়ার পর তাহার তাৎপর্য অসীম। যে ভাবে কমিশনের পক্ষপাত লইয়া প্রশ্ন উঠিয়াছে, যে ভাবে নরেন্দ্র মোদী বারে বারে ছাড় পাইয়াছেন, যে ভাবে নিরপেক্ষতা বা তাহার অভাবের প্রশ্ন কমিশনের অভ্যন্তরীণ বিরোধও প্রকাশ্যে আসিয়াছে, তাহা দেশবাসীর আস্থা ভাঙিবার পক্ষে যথেষ্ট। যাহার হাতে দেশবাসীর রায়ের নিরাপত্তা রক্ষার ভার, তাহাকে লইয়া যদি এত প্রশ্ন থাকে, তাহা কি গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ হইতে পারে? প্রণববাবু বলিয়াছেন, ইভিএম-এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব একান্তই কমিশনের। আশঙ্কা হয়, সেই দায়িত্ব পালনে কমিশনের ব্যর্থতা সম্বন্ধে প্রায় সর্বজনীন আশঙ্কা ভারতকে একটি বিপজ্জনক পথে ঠেলিবে— ইভিএম বাতিল করিয়া ব্যালট ফিরাইয়া আনিবার যে দাবি এত দিন বিচ্ছিন্ন ভাবে শোনা যাইত, অতঃপর গোটা দেশেই তাহার অনুরণন হইবে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
সেই পরিণতি অতি দুর্ভাগ্যজনক। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। কাগজের ব্যালটে ভারতের ৯০ কোটি মানুষের ভোট গণনার কাজটি শ্রমসাপেক্ষ, বিপুল সময়সাপেক্ষও বটে। ইভিএম সেই শ্রম বহুলাংশে লাঘব করিয়াছে। প্রযুক্তির তো তাহাই কাজ। এবং, সেই কারণেই প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি। ইভিএম ব্যবহারে ভারত বিশ্বের অন্যতম পথিকৃৎ। অতি দরিদ্র ও বহুলাংশে নিরক্ষর মানুষের দেশ হইয়াও ১৯৫২ সালের লোকসভা নির্বাচনে সর্বজনীন ভোটাধিকার চালু করিয়া ভারত গোটা দুনিয়ায় যে উদাহরণ স্থাপন করিয়াছিল, ইভিএম-এর ব্যবহার সেই ধারারই উত্তরাধিকার বহন করে। তাহা হইতে সরিয়া আসিতে বাধ্য হইলে অতি লজ্জার ঘটনা হইবে। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, নেদারল্যান্ডস, আয়ার্ল্যান্ড বা জার্মানির ন্যায় দেশ ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করিয়া ব্যালটে ফিরিয়া গিয়াছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় দেশ ইভিএম চালুই করে নাই। কিন্তু, ভারত পারিয়াছিল। প্রশাসনিক অদক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাত আসিয়া যদি সেই কৃতিত্বটিকে কাড়িয়া লয়, সেই লজ্জা ঢাকিবার উপায় থাকিবে না।