প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বন্ধে প্রচার। নিজস্ব চিত্র
৪০ মিলি মাইক্রনের থেকে পাতলা এবং ১৬×১২ ইঞ্চির ক্যারিব্যাগের উপর নিষেধাজ্ঞা আগেই জারি করেছিল রাজ্য প্রশাসন। কিন্তু সেই নিয়ম জারি করার দীর্ঘদিন পরও অপরিবর্তিত রয়েছে এই জেলায় প্লস্টিক ব্যবহারের চিত্র। মাঝে মধ্যে ধরপাকড় হয় ঠিকই কিন্তু তাতেও অবাধে ব্যবহার চলছে। জেলার পঞ্চায়েত এলাকাগুলিতে তো বটেই এমনকি জেলা সদরেও চলছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। এছাড়া দুবরাজপুর পুরসভা, সাঁইথিয়া পুরসভা, রামপুরহাট পুরসভা, নলহাটি পুর এলাকাগুলিতেও কোথাও লুকিয়ে তো কোথাও অবাধে চলছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। বোলপুর-শান্তিনিকেতনকে অবশ্য সাময়িকভাবে প্লাস্টিকমুক্ত বলা যায়।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পক্ষ থেকে, ২০০৭ সালে ৫ জুন থেকে এ রাজ্যে ১৬ ইঞ্চি এবং ১২ ইঞ্চি মাপের চেয়ে ছোট এবং ৪০ মাইক্রনের চেয়ে পাতলা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ব্যবহার, মজুত এবং বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরিবেশবিদ এবং পরিবেশ সচেতন মানুষদের কথায়, যে কোনও প্রকার প্লাস্টিকজাত পদার্থ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। একবার ব্যবহার যোগ্য প্লাস্টিক পরিবেশের উপর ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিক এমন এক প্রকার বর্জ্য পদার্থ যা পরিবেশে পচতে বা কারখানায় পুনঃচক্রিয়াকরণ করতে প্রচুর সময় লাগে। তাই অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্লাস্টিকজাত পদার্থ ব্যবহার করলে পরিবেশে ওই ধরনের বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতেই থাকে যা সমস্ত জীবকুলের পক্ষে ভয়ঙ্কর। এছাড়া প্লাস্টিকের প্রভাবে পশুপাখি, মানুষ, উদ্ভিদ, মাটি, জল, বাতাস-সব কিছুই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্লস্টিকজাত বর্জ্য পদার্থ বিশেষত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক এর জন্য দায়ী। একবার ব্যবহারের পরে প্লাস্টিক ফেলে দেওয়া হয়। ফলে সেই প্লাস্টিক নর্দমার মাধ্যমে জলে গিয়ে মেশে। জল দূষিত হয়, এছাড়া মাটির সাথে মিশে মাটির ক্ষতি করে। তাই প্লাস্টিক দূষণ রুখতে বিভিন্ন সময় নানান বিধিনিষেধ জারি করেছে প্রশাসন, জন সচেতনতায় প্রচারও করা হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্লাস্টিক মুক্ত দেশ গড়ার ডাক দিয়েছেন, এই রাজ্যের সরকারও প্লাস্টিক বর্জনে নিয়েছে নানান উদ্যোগ। কিন্তু সেই নিয়মকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়েই জেলায় জেলায় অবাধে চলছে পলিথিনের ব্যবহার।
জেলাবাসীর দাবি, জেলার সমস্ত প্রান্তেই কম বেশি ৪০ মাইক্রনের থেকে কম প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহৃত হচ্ছে। দোকানে বিক্রেতা এবং ক্রেতা সকলেই প্লাস্টিক ব্যবহার করতে পিছপা নন। উদাহরণ স্বরূপ, সিউড়ি শহরের অধিকাংশ মিষ্টির দোকান, ছোট ছোট রেস্তোরাঁ, মাছ-মাংস-ডিম থেকে আনাজের দোকান সব জায়গাতেই পলিথিনের অবাধ ব্যবহার। বিক্রেতা সযত্নে দ্রব্যগুলিকে ফিনফিনে পলিথিনের মোড়কে মুড়ে দিচ্ছেন এবং ক্রেতারাও হাসি মুখে সেইগুলি নিয়ে যাচ্ছেন। যদিও ক্রেতা বিক্রেতা উভয়েই জানেন যে প্লাস্টিক পরিবেশ বান্ধব নয়। এই নিয়ে খাবারের দোকানের মালিক এবং একজন আনাজ ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা উত্তরে জানান,‘‘ক্রেতারা কোনওকিছু কেনার পরেই ক্যারিব্যাগ খোঁজেন। আমরাও চাই না রাখতে। কিন্তু কি করব ক্রেতা চায়।’’ অন্যদিকে কয়েকজন ক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা বলেন, ‘‘প্রশাসন, পুরসভা বন্ধ করুক, তাহলেই তো হয়।’’ শহরবাসীর একাংশের অভিযোগ যে, প্রতি বছর পুজোর সময় জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ছোট ছোট খাবারের দোকান গজিয়ে ওঠে, সেখান থেকেও ক্রেতাদের প্লাস্টিকজাত দ্রব্য বিশেষত পলিথিনের ব্যাগ দেওয়া হয়। কিন্তু দোকানের পাশে কোন আবর্জনা ফেলার জায়গা না থাকার কারণে ওই আবর্জনাগুলি এদিকে ওদিকে ফেলে দেওয়া হয়। ওই পলিথিন বা প্লাস্টিকজাত আবর্জনাগুলি নর্দমার মুখগুলিতে গিয়ে আটকে যায় এবং বৃষ্টি হলে জল বেরোতে পারে না, ফলে নর্দমার জল রাস্তায় উঠে আসে। এই নিয়ে শহরের বাসিন্দা মুকেশ দে, সোহন রায়, হিন্দোল মজুমদার বলেন, ‘‘এই ঘটনার উদাহরণ হল সেচ কলোনির মাঠ। প্রতি বছরই সিউড়ি সেচ কলোনির মাঠে পুজোকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু দোকান গজিয়ে ওঠে। সেই দোকানের কারণে প্রচুর প্লাস্টিকজাত পদার্থ মাঠের এদিক ওদিকে ফেলা হয়। ফলে পুজোর আগে যে মাঠটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল সেই মাঠটিই পুজোর পর প্লাস্টিকের চাদরে ঢেকে যায়। এমনকি সেচ কলোনির মাঠের চারিদিকে সৌন্দর্যায়নের জন্য বেড়া দিয়ে ঘিরে যে গাছগুলি লাগানো হয়েছে গতবছর সেই বেড়ার ভিতরেও অনেকে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল-সহ অন্যান্য প্লাস্টিকজাত আবর্জনা ফেলেছিেলন।’’ এ প্রসঙ্গে সিউড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা প্রচার আগেও চালিয়েছি। তাছাড়া মাইকে প্রচার করেছি। আমাদের ট্যাবলো ঘুরেছে। কিছুদিন আগেই এক সপ্তাহব্যাপী পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করেছি সেখানে প্লাস্টিক বর্জনের জন্য প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া আমরা পুজোর মধ্যে অথবা পুজোর পরেই প্লাস্টিক-বিরোধী অভিযান চালাব।’’
অনেকটা একই অবস্থা রামপুরহাট এবং সাঁইথিয়া পুরসভার। তবে সেখানে পুরসভার অভিযানের কারণে কিছুটা হলেও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমেছে। যেমন, রামপুরহাট এবং সাঁইথিয়া পুর এলাকায় চায়ের দোকানে প্লাস্টিকের কাপ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লুকিয়ে চুরিয়ে পলিথিনের ব্যবহার এখনও অব্যাহত। এই নিয়ে রামপুরহাট পুরসভার পুরপ্রধান অশ্বিনী তিওয়ারি বলেন, ‘‘মানুষ এখন প্লাস্টিক নিয়ে সচেতন হয়েছে। তাঁরা নিজেরাই এখন প্লাস্টিক ব্যবহার করতে চাইছেন না। আমরা এই নিয়ে অনেক সচেতনতা শিবির করেছি। সম্প্রতি প্লাস্টিক বর্জন নিয়ে যে কর্মসূচি হল তাতে অনেক মানুষ সাড়া দিয়েছেন। এছাড়া পুজো কমিটিগুলিকে বলা হয়েছে তাঁরাও এই ব্যাপারে সচেতনতার প্রচার চালাবে।’’
তবে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে পলিথিন বা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার হলেও গত কয়েকদিনে বোলপুর পুর এলাকা এবং শান্তিনিকেতনকে প্রায়ই প্লাস্টিক মুক্ত গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। মূলত মাস খানেক আগে বোলপুর পুরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করে ৫০ মাইক্রনের কম প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করার জন্য প্রচার করা হয় এবং নিয়ম না মানা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। এরপরেই অভিযান শুরু করে বোলপুর পুরসভা। তারপর থেকেই বোলপুরে ৫০ মাইক্রনের কম প্লাস্টিক ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরিবর্তে কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার শুরু করেন মানুষ। এই নিয়ে বোলপুর পুরসভার পুরপ্রধান সুশান্ত ভকত বলেন, ‘‘৫০ মাইক্রনের কম প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার পর থেকেই মোটামুটি শহরে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ আছে। পুরসভার পক্ষ থেকে প্রায়ই অভিযান চালানো হচ্ছে এবং আমরা অনেকটাই সফল হয়েছি।’’ অন্যদিকে বেশ কয়েক মাস আগে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তরফেও প্রচার চালানো হয়। তারপর থেকে ওই এলাকাতেও প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাগজের ব্যাগ ব্যবহার শুরু হয়েছে।