রামধনু জোট? তাতে ক্ষতি কী

১৯৮১ থেকে ২০০৩ অবধি মহাথির মহম্মদই ছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। যে বারিসান ন্যাসনাল জোটকে হারিয়ে ক্ষমতায় এলেন তিনি, ২২ বছর ধরে তারই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৮ ০০:২০
Share:

রাহুল গাঁধী যদি জোট করতেন দেবগৌড়ার সঙ্গে, কর্নাটকের নির্বাচনের ফল কি অন্য রকম হত? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, হত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভবই ছিল না সেই জোট, সিদ্দারামাইয়া আর দেবগৌড়ার সম্পর্ক এমনই খারাপ। কথাটা শুনলে মুচকি হাসবেন মহাথির মহম্মদ (ছবি)। ৯২ বছর বয়সে ফের মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন তিনি। এমন এক জোট গড়ে, যার পাশে কংগ্রেস আর জেডিএস-কে আজন্ম বন্ধু মনে হওয়াও বিচিত্র নয়।

Advertisement

১৯৮১ থেকে ২০০৩ অবধি মহাথির মহম্মদই ছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। যে বারিসান ন্যাসনাল জোটকে হারিয়ে ক্ষমতায় এলেন তিনি, ২২ বছর ধরে তারই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। গণতন্ত্রে খুব আস্থাবানও ছিলেন না। সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা, বিচারবিভাগের ওপর যারপরনাই দখলদারি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ— এমনকী নিজের দলের নেতাদেরও— যথেচ্ছ মামলায় ফাঁসিয়ে জেলবন্দি করা, তাঁর আমলে হয়েছে সব কিছুই।

এ হেন মহাথিরকে ফিরে পেয়েই আবেগে ভেসে যাচ্ছে দেশ, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালয়েশিয়ার গণতন্ত্রের জয়ধ্বনি উঠছে— শুনলে অবাক না হওয়ার ঠিক দুটো কারণ আছে। দ্বিতীয় কারণটি হল, গণতন্ত্র নামক ধারণাটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কখনও তেমন শিকড় গাড়তে পারেনি। উপনিবেশের যুগ শেষ হওয়ার পর থেকেই সেখানে মূলত একনায়কের যুগ। ফলে, একনায়ক ছিলেন বলেই মহাথির ব্রাত্য, এ কথা মানুষ মনে করেননি। বরং, তাঁর আমলেই দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছিল, গুরুত্ব পেয়েছে এই কথাটি। এবং, দীর্ঘ ছয় দশক পরে ক্ষমতাচ্যুত হচ্ছে বারিসান ন্যাসনাল, আর তা হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই, এটা উদ্‌যাপন করার মতোই ঘটনা বটে। আর, অবাক না হওয়ার প্রথম কারণটি হলেন নাজিব রাজ়াক, মালয়েশিয়ার সদ্য-ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী।

Advertisement

২০০৯ থেকে ক্ষমতায় থাকা নাজিবের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ প্রচুর। তার এক দিকে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিরাচরিত রোগ— গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ। বিচারবিভাগকে তাঁবে রাখার চেষ্টা থেকে বিরুদ্ধবাদী রাজনীতিকদের জেলবন্দি করা, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, নাজিব তাঁর পূর্বসূরিদের অনুসরণ করেছেন বিলকুল— বিশেষত মহাথির মহম্মদকে! তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভের অন্য কারণ অর্থনৈতিক— তেল থেকে এলপিজি, চিনি, বহু পণ্যের থেকে বিপুল ভর্তুকি প্রত্যাহার করেছেন তিনি। অসুবিধায় পড়েছেন গ্রামীণ মানুষ। দেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন জিএসটি। সেই কর অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। তিন নম্বর কারণ সাম্প্রদায়িক। মালয়েশিয়ায় জাতিবৈর বিপুল। ‘ভূমিপুতর’ মালয়দের সঙ্গে চিনা জনগোষ্ঠীর সম্পর্কের তিক্ততা পাকাপাকি সমস্যা। চিনারা সে দেশে সংখ্যালঘু, কিন্তু সংখ্যায় এত কমও নন যে তাঁদের ওপর নির্দ্বিধায় মালয় বুলডোজ়ার চালিয়ে দেওয়া যাবে। নাজিবের শাসনকালে চিনাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বেড়েছে বিপুল হারে। ক্ষোভের চতুর্থ কারণ, নাজিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিপুল অভিযোগ।

যদি কেউ মালয়েশিয়ার সঙ্গে ভারতের, নাজিব রাজ়াকের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর মিল খুঁজে পান; চিনাদের অনিশ্চয়তার সঙ্গে অসহায়তার অনুভূতির সঙ্গে যদি সাদৃশ্য দেখেন ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থার; গণতন্ত্রের অবমাননায়, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধে যদি এক মনে হয় দু’দেশকে; তবে জানানো যাক, মিল এখানেই শেষ নয়। ছোট মিল হল, মোদী যেমন রেডিয়োতে ‘মন কি বাত’ শোনান, টুইটারে সক্রিয় থাকেন প্রতি নিয়ত, নাজিবেরও তেমন ছিল ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’, দেশের মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগরক্ষার ব্যবস্থা, অথবা বিরোধীদের মতে, সাইবার আর্মি ব্যবহার করে মিথ্যে আর ডাহা মিথ্যে কথা বলে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে নিজের দিকে টেনে রাখার আয়োজন। সরকারের যে কোনও প্রকল্পে যেমন সংবাদপত্রের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে নির্বিকল্প নরেন্দ্র মোদীর মুখ, মালয়েশিয়ায় ঠিক তেমনই ছিলেন নাজিব রাজ়াক।

আর, বড় মিল? বিরোধী মহাজোটে। নাজিব রাজ়াককে হারাতে এককাট্টা হয়ে জোট বেঁধেছেন বিরোধীরা। এমন সব রাজনীতিককে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসেছে এই জোট, দু’বছর আগে যা ছিল কল্পনারও অতীত। সবচেয়ে বড় উদাহরণ আনোয়ার ইব্রাহিম। স্থির হয়ে আছে, ঠিক দু’বছর পর মহাথির প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি খালি করে দেবেন, আর তাতে বসবেন আনোয়ার। সেই আনোয়ার ইব্রাহিম, একদা যিনি মহাথিরের উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন, এবং ১৯৯৮ সালে যাঁকে জেলে পুরেছিলেন মহাথির। মুক্তি পাওয়ার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ফের জেলবন্দি হন তিনি, ২০০৪ সালে। সেই থেকে এখনও জেলেই। বিপুল রাজনৈতিক তিক্ততা সরিয়ে মহাথিরের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন আনোয়ার। রাজনৈতিক বিরোধ ভুলে মহাথিরের হাত ধরেছেন মহিউদ্দিন ইয়াসিনও। এখনও নাজিবের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী, পরে সমালোচক এবং শত্রু। বিরোধীদের মহাজোটের রিজঁ দেত্রে— অস্তিত্বের মূল কারণ— প্রত্যেকে যে কোনও মূল্যে নাজিবের পতন চান।

সেই তাগিদেই মহম্মদ মহাথিরের হাত ধরেছেন ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টির নেতারাও। ডিএপি-র শীর্ষ নেতারা মহাথিরের আমলে বিনা বিচারেই জেল খেটেছেন। এবং তার চেয়েও বড় কথা, মহাথির তাঁদের দেগে দিয়েছিলেন চিনা স্বার্থের প্রতিনিধি, অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়ের শত্রু হিসেবে। এই সব জোটের পাশাপাশি কর্নাটকে কংগ্রেস আর জেডিএস-এর জোটকে কি খুব সম্ভাব্য মনে হয় না? তার পিছনে মহাথিরের মস্ত ভূমিকা। তিনি জনসমক্ষে নিজের অতীত আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। প্রত্যেক অতীত বিরোধীর কাছে গিয়েছেন, নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। আর, তার ফলেই মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এই প্রথম শোনা যাচ্ছে এক সত্যি বহুজাতিকতার সুর।

অমিত শাহ হয়তো বলতেন, ‘কুকুর-বেড়ালের জোট’। বা, রামধনু জোট। সেই কটূক্তিতে কান না দিয়ে বরং ভারতে বিজেপি-বিরোধী জোটের কান্ডারিরা মালয়েশিয়ার নির্বাচনের ফলাফল দেখে আশাবাদী হতে পারেন। প্রায় কল্পনাতীত একটা জোট যখন রাষ্ট্রের তৈরি করা যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে টপকে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়ে আসে, তখন বোঝা যায়, অপশাসনের বিরুদ্ধে জমে ওঠা মানুষের ক্ষোভকে একত্রিত করতে বিরোধী রাজনীতির দায়িত্ব কম নয়। তার জন্য নিজেদের জায়গা ছেড়ে সরতে হতেই পারে, কিন্তু সেই সরে আসা গণতন্ত্রের স্বার্থেই। এবং, রাজনীতির ময়দানে অসম্ভবও কিছুই নয়। হতেই পারে তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএমের জোট, চন্দ্রবাবু নায়ডু আর জগন্মোহন রেড্ডি আসতেই পারেন এক মঞ্চে। সে রাজনীতি যে সম্ভব, মায়াবতী আর অখিলেশ যাদব দেখিয়ে যাচ্ছেন। কাল মেহবুবা মুফতি আর ওমর আবদুল্লাও দেখাবেন না, কে বলতে পারে?

রামধনু জোট? না-হয় তাই হল। রামধনুর শেষ প্রান্তে গুপ্তধন থাকে, শিশুরা বিশ্বাস করে। পাশুপত অস্ত্রও থাকে কি না, খুঁজে দেখতে দোষ কী?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement