উত্তর-পশ্চিম ভারতের কৃষকরা পঙ্গপালের বিপদ সম্পর্কে বিলক্ষণ অবহিত, গত বৎসরেও গুজরাতে পঙ্গপাল হানা দিয়াছিল।
দেখিতে নিরীহ ফড়িংয়ের ন্যায়, কিন্তু দল বাঁধিলে মূর্তিমান বিপদ। উত্তর-পশ্চিম ও মধ্য ভারতের অন্তত পাঁচটি রাজ্য এই মুহূর্তে পঙ্গপালের আক্রমণে প্রমাদ গনিতেছে। পাকিস্তান হইতে পঙ্গপালের ঝাঁক রাজস্থানে ঢুকিয়াছে, পরে ছড়াইয়া পড়িয়াছে গুজরাত, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রেও। সতর্কতা জারি হইয়াছে পঞ্জাব ও দিল্লিতে। পতঙ্গ ক্ষুদ্র হইলেও বিপদ উপেক্ষণীয় নহে, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক পূর্বেই চেতাবনি দিয়াছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের কৃষকরা পঙ্গপালের বিপদ সম্পর্কে বিলক্ষণ অবহিত, গত বৎসরেও গুজরাতে পঙ্গপাল হানা দিয়াছিল। কিন্তু এই বারের আক্রমণ গত তিন দশকে সবচেয়ে গুরুতর। পঙ্গপালের একটি ঝাঁক এক বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ হইতে পারে, তাহাতে আট কোটি পতঙ্গ থাকিতে পারে। রাজস্থানে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলিয়াছেন, সম্প্রতি দৃষ্ট ঝাঁকটি তিন-চার কিলোমিটার দীর্ঘ।
সঙ্কটের ছায়াটি দীর্ঘতর। কারণ, দেশে এখন খারিফ শস্যের মরশুম। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির কৃষিক্ষেত্র হইতে সব ফসল কৃষকের ঘরে উঠে নাই, পঙ্গপাল তাহা ধ্বংস করিতে পারে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজ়েশন সতর্ক করিয়াছে, ‘ডেজ়ার্ট লোকাস্ট’ বা মরু পঙ্গপাল গোত্রের এই পতঙ্গ বিশ্বের সকল পরিযায়ী পতঙ্গের মধ্যে সব থেকে বেশি বিপজ্জনক, তাহারা এক দিনে দেড়শত কিলোমিটার অতিক্রম করিতে পারে, এক বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ একটি ঝাঁক কয়েক ঘণ্টায় যে পরিমাণ ফসল খাইয়া ফেলিতে পারে, ওজনের নিরিখে তাহা ৩৫,০০০ মানুষের খোরাক। গত বছর ডিসেম্বরে গুজরাতে ২৫,০০০ হেক্টর জমির ফসল পঙ্গপালের প্রকোপে নষ্ট হইয়াছিল। এখন তাহাদের আক্রমণে অন্তত আট হাজার কোটি টাকার ডালশস্য বরবাদ হইবার আতঙ্কে সিঁটিয়া আছেন মধ্যপ্রদেশের কৃষক। উত্তরপ্রদেশের মথুরায় প্রশাসন টাস্ক ফোর্স গঠন করিয়াছে, দমকল বাহিনীকে পাইপে রাসায়নিক স্প্রে ভরিয়া প্রস্তুত থাকিতে বলিয়াছে। মধ্যপ্রদেশে কৃষি মন্ত্রক চাষিদের জন্য নির্দেশিকা জারি করিয়াছে, রাসায়নিকের ব্যবহারে বা থালাবাসন ঢাকঢোল পিটাইয়া যাহা করিয়াই হউক পঙ্গপাল তাড়াইতে পারেন।
অতিমারির জেরে সারা দেশ ধুঁকিতেছে। বাংলাকে তছনছ করিয়াছে ঘূর্ণিঝড়, অসমে বন্যার ভ্রুকুটি। উত্তর ভারতে কয়দিন ধরিয়াই তাপপ্রবাহ চলিয়াছে, ইহার মধ্যে আবার আসিয়া জুটিল পঙ্গপাল। দুর্যোগের যেন শেষ নাই। প্রতিটি দুর্যোগই অর্থনীতির উপর বিষম আঘাত হানিতেছে। শিল্প-বাণিজ্য ও চাকুরিক্ষেত্র ইতিমধ্যেই ন্যুব্জ হইয়া পড়িয়াছিল, কৃষিও বাদ যাইল না। ইহার মধ্যে পঙ্গপালরা আসিয়া পড়িল। অবশ্য পঙ্গপালদের আগমনের মধ্যে একটি রূপক খুঁজিয়া পাওয়াও অসম্ভব নহে। বিজ্ঞানীরা বলিয়া থাকেন, এই ক্ষুদ্রাকার পোকাজাতীয় জীবটি সাধারণ সময়ে একা বা ছোট দলে বিচরণ করিলেও, যখনই বড় সঙ্কটে পড়ে, যখনই খরা কিংবা মহামারির কারণে নিজেদের পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করিতে পারে না, তখনই তাহারা দল বাঁধে, অধিক প্রজনন ঘটায়, এবং এমন ঝাঁক বাঁধে যে বলীয়ান ও গরীয়ান মানবপ্রজাতি তাহার সহিত পাল্লা দিয়া পারিয়া উঠে না। অর্থাৎ প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হইবার মন্ত্রটি ইহারা খুব জানে। বিশেষত সঙ্কটকাল যে সকলের একত্র হইবার কাল, তাহা তো জানেই।