যুগ যুগ ধরে আত্তীকরণ করেছে এ ভূমি। সময়ের প্রবাহে সওয়ার হয়ে শক-হুন দল, পাঠান-মোগল এ দেশে লীন হয়েছে। যার পদার্পণ ঘটেছে এই ভূভাগে, তাকেই আপন করেছে ভারতীয় সভ্যতা, সেও আপন করেছে ভারতকে।
বসুধৈব কুটুম্বকম— এ মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দুর সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপনের এই বীজমন্ত্রেই নিহিত ভারতের এই আত্তীকরণের মহৎ শক্তি। এই বীজমন্ত্রে বলীয়ান বলেই শত-সহস্র অনতিক্রম্য প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে এসে আজকের এই বিপুল ব্যাপ্তি, এই বিরাট প্রসার ভারতীয় সভ্যতার।
অন্যকে আপন করতে পারার মধ্যেই প্রসার। কাছে টানা যায় যত বেশি, সভ্যতার পরিধি ততই বাড়ে। সেই সম্প্রসারণেই সভ্যতার বিকাশ। আর সঙ্কোচনে মৃত্যু। সম্প্রসারণের পথেই যে আমরা রয়েছি, এখনও যে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এই রয়েছি, তার অনন্য দুই নজির রাখল ভারত।
আন্তর্জাতিক এক কর্মসূচিতে যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন পাকিস্তানের মেয়েরা। তার মধ্যেই ঘটে গেল উরি, ঘটে গেল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। দেশে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছিল পাক মেয়েদের। চিন্তা বাড়ছিল সীমান্ত-পারের পরিবারগুলিতে। খবর পেয়েই ভারতের বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ আশ্বস্ত করলেন, নির্বিঘ্নে পাকিস্তানে ফিরবেন মেয়েরা। কাজও হল আশ্বাস অনুযায়ীই। সুষমা জানালেন, মেয়েরা সবার আপন, তাঁদের জন্য কোথাও কোনও সীমান্ত নেই।
নমুনা আরও আছে। তৃষ্ণার্ত বালক জলের খোঁজে সন্ধের আলো-আঁধারি সীমান্ত-পথে দিকভ্রষ্ট। পাকিস্তানের সীমা পেরিয়ে কখন ঢুকে পড়েছিল ভারতে, বুঝতেই পারেনি। মাত্র বছর বারোর ছেলেটা যে পথভ্রষ্টই, তা বিশ্বাস করতে একটুও কষ্ট হয়নি ভারতের সীমান্তরক্ষীদের। রাতে আশ্রয় দেওয়া হল। সকালে সস্নেহে পাক বালককে তার দেশের সীমায় পৌঁছে দেওয়া হল।
দু’টি ক্ষেত্রেই বার্তাটা আত্তীকরণের, আপন করে নেওয়ার। রাজনীতিতে লড়াই রয়েছে, রাষ্ট্রনীতিতে লড়াই রয়েছে, সীমান্তে আগুনও রয়েছে। কিন্তু মানুষে-মানুষে কোনও বৈরিতা নেই, মানব সভ্যতায় কোনও বিভাজন নেই। কারণ সভ্যতার কোনও সীমান্ত হয় না, সভ্যতার বিকাশ কোনও দিনই কোনও কাঁটাতারের শাসন মেনে ঘটেনি। দেশগুলো ভেঙেছে, কিন্তু সভ্যতা অখণ্ডই।
এই উপলব্ধিটার অবস্থান ভারতীয়ত্বের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। দু’টো ঘটনাই প্রমাণ করল, ভারতের হৃদয় এখনও সুস্থ-সবলই। প্রমাণ করল আমাদের চালিকাশক্তি এখনও আমাদের হৃদয়ের সুগভীর অন্তঃস্থল থেকেই উৎসারিত হয়।
অতএব, আরও ব্যাপ্তি, আরও প্রসার অপেক্ষায় আমাদের। সীমান্ত-পারে হৃদয় যদি সঙ্কুচিত থাকে এর পরেও, অপেক্ষায় তা হলে অশেষ অন্ধকার।