কে জয়ী হবে, পাকিস্তানে নির্বাচন ঘিরে এই প্রশ্নটাই বার বার উঠে আসছে। এ বিষয়ে যাঁরা মতামত দিচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশের বক্তব্য: প্রাক্তন ক্রিকেটার, এখন রাজনীতিক ইমরান খানের পাল্লাই ভারী। তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-এ-ইনসাফ (পিটিআই) দেশের সর্বশক্তিমান সেনার মদতে পুষ্ট। পাকিস্তান সেনা নাকি দুর্বল সরকার চাইছে মসনদে। যে সরকারকে ভুলিয়েভালিয়ে, চোখ রাঙিয়ে, প্রয়োজনে ঘাড়ে ধরে সেনার ইচ্ছেমতো চলতে বাধ্য করা যাবে। এক জন শক্তপোক্ত, অবাধ্য ইমরান খান যাতে মাথা চাড়া না দেন, কট্টর ইসলামপন্থীদের রাজনীতির ময়দানে ঢুকিয়ে সেনানায়করা সেই সম্ভাবনাকে এখনই নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছেন।
এমন নয় যে, পাকিস্তান সেনা এই প্রথম বার দেশের আইনসভায় দুর্বল সরকার বসাতে চাইছে। তারা আগেও বহু বার এই কৌশল প্রয়োগ করেছে এবং তাতে বিভিন্ন মাত্রায় সাফল্যও পেয়েছে। ১৯৭০ সালে একনায়ক ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনে রাজি হয়েছিলেন, কারণ তিনি ভেবেছিলেন কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, খণ্ডিত ফলাফল হবে, এবং মসনদে তিনিই বিরাজ করবেন। কিন্তু ভোটের ফল দেখায়, তিনি কতটা ভুল ভেবেছিলেন! পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামি লিগ আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল। পাকিস্তান এক জন বাঙালির দ্বারা শাসিত হবে— পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তিধররা এটা মেনে নিল না। এবং সেই অনড় আপত্তির কারণে পাকিস্তান ভাঙল।
এ বার পাকিস্তান সেনা তার স্বীকৃত সহযোগী এবং ইসলামপন্থীদের প্রচুর সাহায্য করেছে। সেই কারণেই এই ভোটে সেনার বিশেষ ঘনিষ্ঠ, জঙ্গি হাফিজ় সইদকে তার অনুগতদের একটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচনে দাঁড় করাতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হাফিজ় সইদ নিজে নির্বাচনে লড়ছে না (কেন সেটা বলাই বাহুল্য), কিন্তু তার দল, মিল্লি মুসলিম লিগ ২০০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
এক দিকে চরম ইসলামপন্থীদের মূল ধারার রাজনীতিতে যোগদানে উৎসাহিত করা হচ্ছে, অন্য দিকে দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দল, নওয়াজ় শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ়) এবং জ়ুলফিকর আলি ভুট্টোর তৈরি পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে কার্যত অনাথ করে দেওয়া হয়েছে। দুই দলের নেতারা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফ গত জুনে বরখাস্ত, এখন তিনি ও তাঁর কন্যা জেলে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা, প্রয়াত বেনজ়ির ভুট্টোর স্বামী, আসিফ আলি জ়ারদারিকে ফেরার ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি দেশের মাটিতে পা রাখলেই গ্রেফতার হবেন।
স্পষ্টতই, পাকিস্তান সেনা দেশের অসামরিক নেতৃত্বকে ক্ষমতাহীন করে রাখতে চাইছে। ইসলামাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি শওকত আজ়িজ় সিদ্দিকির অভিযোগ, বিচারব্যবস্থার রায়কে প্রভাবিত করছে গোয়েন্দারা। তাঁর বক্তব্য, আইএসআই প্রধান বিচারপতিকে বলেছে, ভোটের সময় নওয়াজ় শরিফ ও তাঁর মেয়ে যাতে জেলের মধ্যেই থাকেন সেই ব্যবস্থা যেন পাকা করা হয়।
সেনাবাহিনী কেন এতটা মরিয়া যে মার্কামারা সন্ত্রাসীদের তারা আইনসভায় ঢোকাতে চায়, চাপে রাখতে চায় বিচারপতিদের, বড় বড় রাজনৈতিক দলের মাথাদের সরিয়ে দিতে চায়? এর কারণ নিহিত রয়েছে পাকিস্তানের গভীর সঙ্কটের মধ্যে। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সে দিন অবধি পাকিস্তানকে কোটি কোটি ডলার দিতে এবং সস্তায় অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে উৎসাহী ছিল, এখন তাদের সেই উদারতা আর নেই। পাকিস্তানের আর এক সহায় সৌদি আরব, তার আর্থিক অবস্থাও এখন ভাল নয়। চিন পাশে আছে বটে, কিন্তু তারা বরাবরই অনেক হিসেবনিকেশ করে সাহায্য দেয় এবং সেটাও দেয় ঋণ হিসেবে। চিনের কাছে ধারের বোঝা দ্রুত বাড়ছে, পাকিস্তান ক্রমশ দেনার দায়ে ডুবে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ছে জ্বালানির খরচ। পাকিস্তানকে তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য অনেক কিছুই আমদানি করতে হয়, নিজের আয় থেকে তার খরচ মেটানোর সামর্থ্য নেই। এর পরিণামে পাকিস্তানি টাকার দাম অভূতপূর্ব ভাবে কমেছে— এখন মার্কিন ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ১২৫ টাকা।
নওয়াজ় শরিফ যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, দেশের অর্থনীতি ভালই করছিল। ২০১৭ সালে জিডিপির বৃদ্ধি-হার পৌঁছেছিল ৫.৭ শতাংশে, দশ বছরে সর্বাধিক। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে জেনারেল পারভেজ় মুশারফ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং পিপিপি-র আসিফ আলি জ়ারদারির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ পরিষ্কার হয়, সে বছর জিডিপি বৃদ্ধির হার ঠেকেছিল মাত্র ১.৭ শতাংশে। ২০১৩ জুনে নওয়াজ় শরিফ আইনসভার নির্বাচনে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হন। শাসনক্ষমতার সুষ্ঠু হস্তান্তর, আর্থিক সংস্কার এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে বিনিয়োগের অনুকূল পরিস্থিতি— সব মিলিয়ে পাকিস্তানের জিডিপি বৃদ্ধির হার ২০১৩’র ৪.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৭’য় দাঁড়ায় ৫.৭ শতাংশ। ওই বছরেই আদালতের রায়ে শরিফ গদিচ্যুত হন। অনুমান, বিচার বিভাগের এই নির্দেশের পিছনে সেনাবাহিনীর কালো হাত ছিল, শরিফের প্রশাসনিক সাফল্য তাঁকে প্রায় অপরাজেয় করে তুলছিল, সেনাকর্তাদের পক্ষে সেটা হজম করা সম্ভব হয়নি। শরিফও এটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি যে সমস্ত বিষয়কে নিজের এক্তিয়ার বলে মনে করেন সেখানে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করে চলবেন না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ কী ভাবে ঠিক হবে, সেনা কর্তাদের পদে কাদের বসানো হবে, বিদেশ নীতি কী হবে, এই সব ব্যাপারে তিনি বেশি ক্ষমতা দাবি করেছিলেন। সেনাবাহিনীর পক্ষে এ সব দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
নানা কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অনেক টাকা দরকার— আফগানিস্তানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চালানো বা কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারতীয় সেনার মোকাবিলা তো আছেই, আছে সামরিক পরিকাঠামো আধুনিকীকরণের তাগিদও। পাশাপাশি, তারা চায় না, চিনের সঙ্গে তাদের লেনদেনে পাকিস্তানের অসামরিক প্রশাসন নাক গলাক। চিন এখন পাকিস্তানের কড়া অভিভাবকের ভূমিকায়, তারা এমন নানা নির্দেশ দিচ্ছে, পাকিস্তানের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার উপর যার বড় রকমের প্রভাব পড়বে। পাকিস্তানের বিরাট এলাকা এখন চিনের দখলে, আরও হাজার হাজার একর তাদের নিয়ন্ত্রণে। বেজিংয়ের উপর পাক সেনার নির্ভরশীলতা উত্তরোত্তর বাড়বে, ফলে নানা বিষয়ে চিনের চাপের কাছে দেশকে আরও বেশি নতিস্বীকার করতে হবে, কোনও স্বাধীনচেতা সরকারের পক্ষে সেটা মানা কঠিন। এই কারণেই ইসলামি উগ্রবাদীদের কাজে লাগাতে চায় সেনাবাহিনী— তারা অসামরিক রাজনীতিকদের ভয় দেখাবে ও জনপ্রতিনিধিদের চাপে রাখবে, যাতে তারা দুর্বল থাকে, চিনের কাছে দেশ বিকিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জোর না পায়।
সেনাবাহিনীর চিন্তা একটাই। অনেক বছরের সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও পাকিস্তানের ভোটারদের মধ্যে একটা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক চেতনা কাজ করে। অসামরিক নেতাদের দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অপদার্থ প্রতিপন্ন করে তাঁদের লোকের কাছে হেয় করার যে কৌশল সেনাবাহিনী বরাবর নিয়ে এসেছে, এ বার সেটা কাজ না-ও করতে পারে। সম্প্রতি দেখা গিয়েছে— পাক সেনার সদর দফতরের সামনে বহু মানুষ আইএসআই-বিরোধী স্লোগান দিচ্ছেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এ দৃশ্য অভূতপূর্ব। অতীতে পাকিস্তানের মানুষ একাধিক বার সামরিক কর্তাদের বোকা বানিয়েছেন। আবার যদি তেমনটা ঘটে, অবাক হওয়ার কারণ নেই।