পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও নথিভুক্তির দাবি পেশ করলেন রাজ্য সরকারের কাছে। তাঁদের দাবি, রাজ্যের সব গ্রামীণ অচিকিৎসক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের নথিভুক্ত করতে হবে। বিষয়টি বিতর্কিত— গ্রামে চিকিৎসকের ঘাটতি পূরণ করতে আরও চিকিৎসক পাঠানো উচিত, না কি প্রশিক্ষিত ‘চিকিৎসা-সহায়ক’ তৈরি করে তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত? গত বছরই মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিন বছরের প্রশিক্ষণে ‘ডিপ্লোমা ডাক্তার’ তৈরির প্রস্তাব তুলেছিলেন নবান্নে একটি প্রশাসনিক বৈঠকে। তা নিয়ে শোরগোল উঠতে স্বাস্থ্য দফতর জানায়, তারা ‘স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পেশাদার’ তৈরির জন্য কমিটি তৈরি করবে। স্মরণীয়, বামফ্রন্ট সরকারও তিন বছরের প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রামীণ চিকিৎসক তৈরি করতে চেয়েছিল। বর্তমানে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ভারতে রোগী-চিকিৎসক অনুপাত হিসাব করতে গিয়ে ‘আয়ুষ’ ডাক্তারদেরও অন্তর্ভুক্ত করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকার করে না। অর্থনীতিবিদ এবং জনস্বাস্থ্য আন্দোলনকারীদের একাংশের দাবি, বহু উন্নয়নশীল দেশে চিকিৎসার প্রয়োজন অনেকখানি মেটান ডিগ্রিহীন চিকিৎসা কর্মীরা। তাঁদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে আনা দরকার। অপর পক্ষে যুক্তি, স্বাস্থ্যের অধিকার সব নাগরিকের সমান, তাই গ্রামের মানুষদের জন্য ‘দ্বিতীয় শ্রেণির চিকিৎসক’ তৈরির চেষ্টা অনৈতিক।
পশ্চিমবঙ্গে অচিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প (২০১২-২০১৫) চলেছিল। ২০১৭ সালে বেশ কিছু প্রশিক্ষিত কর্মীর নথিভুক্তিও করে রাজ্য সরকার। স্পষ্ট করা হয় যে, এঁরা কখনওই নিজেদের ‘চিকিৎসক’ বলে দাবি করতে পারবেন না, বিপন্ন রোগীদের সহায়তায় কিছু নির্দিষ্ট পরিষেবা দিতে পারবেন। এই প্রশিক্ষণ এবং নথিভুক্তির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল চিকিৎসা-বিপর্যয়ের সম্ভাবনা কমানো। ভারতের গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ রোগী যান অপ্রশিক্ষিত চিকিৎসাকর্মীর কাছে। তাই ভুল বা অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসার ঝুঁকি সহজেই অনুমেয়। পাশাপাশি, গ্রামের মানুষ যদি সরকার-নথিভুক্ত পরিষেবা প্রদানকারীদের বেছে নেন, তা হলে তাঁদের ঝুঁকি কমবে, এমনও আশা করা হয়েছিল। গ্রামীণ ভারতের অসংগঠিত চিকিৎসা ক্ষেত্রটি সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত। সেখানে শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ আনা সরকারেরই দায়িত্ব— এই ধারণা থেকেই প্রশিক্ষণ ও নথিভুক্তির উদ্যোগ করেছিল রাজ্য সরকার।
তবু মূল প্রশ্নটি থেকেই যায়— চিকিৎসকের ঘাটতির সুরাহা কি হবে? সন্দেহ হয় যে, শব্দপ্রয়োগের সামান্য হেরফের (‘ডাক্তার’ না বলে ‘মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার’) করে কার্যত আসল সমস্যার থেকে নজর ঘোরানো হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মী যত প্রশিক্ষিতই হন, চিকিৎসকের জায়গা নিতে পারেন না। গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পরবর্তন এসেছে। প্রতিটি জেলায় মেডিক্যাল কলেজ খোলার নীতি নিয়েছে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার টেলিমেডিসিন এবং অন্যান্য প্রযুক্তি-নির্ভর চিকিৎসার প্রসারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিকে ‘সার্বিক সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ তৈরির নীতিও গৃহীত হয়েছে। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি রূপায়ণ হলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অচিকিৎসকদের প্রয়োজন কমবে। ভাল স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ করাই সরকারের কাজ। ‘মন্দের ভাল’ পরিষেবার ব্যবস্থা লক্ষ্য হতে পারে না।