শহর পরিচ্ছন্ন রাখার মূল দায়িত্বটি পুরসভার। গত বছরের শেষ লগ্নে কলকাতায় পুরভোট সম্পন্ন হয়ে নতুন প্রশাসকমণ্ডলী ক্ষমতায় এসেছে। অতঃপর প্রত্যাশা, শহরের পরিচ্ছন্নতা এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হবে। কিন্তু সুস্থ, স্বাভাবিক বুদ্ধি যা বলে, এই শহর সর্বদা যে সে দিকে চলে না— সে প্রমাণ কলকাতার আনাচেকানাচেই স্পষ্ট। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রিন্সেপ ঘাটের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রবল উষ্মা প্রকাশ করেছেন, এবং মহানাগরিককে অবিলম্বে এই অঞ্চল পরিষ্কারের নির্দেশও দিয়েছেন। শুধুমাত্র তা-ই নয়, রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে এক বৈঠকে তিনি সার্বিক ভাবে শহরের রাস্তাঘাট পরিষ্কারের কাজটিতেও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। অতঃপর প্রত্যেক বারের মতোই ধমক খেয়ে পুরসভার ঘুম ভাঙে, মহানাগরিক প্রিন্সেপ ঘাট পর্যবেক্ষণে যান, এবং প্রত্যাশামতোই এ বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার অভিযোগ আনেন।
প্রশ্ন হল, সরকরি কাজে গতি আনতে প্রতি বার প্রশাসনের শীর্ষব্যক্তির উষ্মা প্রকাশের প্রয়োজন পড়বে কেন? কেন মুখ্যমন্ত্রীকে বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে যে, কাজে ফাঁকি পড়ছে। সর্বোপরি, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য এই বছরের ডেঙ্গি সংক্রমণের প্রাবল্যের পরিপ্রেক্ষিতেও তাৎপর্যপূর্ণ। অপরিচ্ছন্নতা এবং যত্রতত্র জঞ্জাল জমে থাকা শুধুমাত্র দৃশ্যদূষণ ঘটায় না, এই আবর্জনার স্তূপগুলিকেই বিশেষজ্ঞরা মশার আঁতুড়ঘর হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। স্তূপীকৃত জঞ্জালে পড়ে থাকা কাপ, বা ভাঙা পাত্রগুলি অবধারিত ভাবে পতঙ্গবাহিত রোগের উৎসস্থল হয়ে ওঠে। এই উদাসীনতা এবং অপদার্থতার মাসুল গোনেন এলাকাবাসী, জীবনের বিনিময়ে। প্রতি বছর কলকাতার যে অঞ্চলটি ডেঙ্গি আক্রান্তের নিরিখে প্রথম সারিতে থাকে, সেই বিধাননগর এলাকাতেও রাস্তার ধারে, ফাঁকা জমিতে পড়ে থাকা আবর্জনা নিয়মিত সাফ হয় না বলে বাসিন্দাদের দীর্ঘ দিনের অভিযোগ। অ-কাজের অজুহাত হিসাবে প্রায়শই উঠে আসে, জমি সংক্রান্ত আইনি জটের কথা। যেখানে মূল প্রশ্নটি জনস্বাস্থ্যের, সেখানে অসহযোগিতা বা আইনি জটগুলি দ্রুত মেটানোর ব্যবস্থা করা হয় না কেন, সে প্রশ্নের সদুত্তর পুরসভার ভান্ডারে থাকে না।
এবং এটাই উদ্বেগের কারণ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এগারো বছর অতিক্রান্ত। অথচ, এখনও এমন কোনও ব্যবস্থাপনা বা কর্মপ্রণালী জন্ম নিল না, যেখানে প্রতিটি সরকারি বিভাগ নিজ দায়িত্বটি নির্দিষ্ট সময়ে সুসম্পন্ন করবে। বরং, প্রতি ক্ষেত্রে প্রশাসনের শীর্ষস্থান থেকে নির্দেশ বা তাড়না না এলে সেই কাজটিতে কাঙ্ক্ষিত গতি কখনও আসে না। জঞ্জাল পরিষ্কার বা রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণের মতো কাজে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের বিন্দুমাত্র প্রয়োজন পড়ে না, যদি সংশ্লিষ্ট বিভাগ বছরভর স্বাভাবিক ছন্দে সেই নজরদারির কাজটি করে চলে। কিন্তু তা যে হয় না, তার কারণ সমগ্র কাঠামোটিই এক চূড়ান্ত এককেন্দ্রিক ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রশাসনের এক জনের হাতেই সমগ্র ব্যবস্থাটি পরিচালনার জিয়নকাঠি। অন্যরা মূলত তাঁর নির্দেশ পালনেই অভ্যস্ত, এখনও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেননি। ফলে, বহু ছোটখাটো কাজও শুধুমাত্র উদ্যোগের অভাবে সম্পন্ন হয় না। প্রিন্সেপ ঘাটের অপরিচ্ছন্নতা তো হিমশৈলের চূড়ামাত্র।