সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিরোধী পক্ষ একটি তর্কে জড়িয়ে পড়ল— সরকার বলল যে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তার স্বাস্থ্য ভাল; বিরোধীরা বললেন, স্বাধীনতার পরে ভারতের অবস্থা কখনও এত খারাপ হয়নি। এ জাতীয় তর্ক হয়েই থাকে বলে প্রসঙ্গটি উড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু, অন্তত বর্তমান তর্কটিতে দু’পক্ষই পরিসংখ্যান ব্যবহার করেছেন— গণপরিসরে থাকা, প্রামাণ্য পরিসংখ্যান, যা মিলিয়ে দেখে নেওয়া সম্ভব। যেমন, অর্থ মন্ত্রকের রিপোর্ট বলছে যে, দেশের ভান্ডারে এখন যত বিদেশি মুদ্রা রয়েছে, তা দিয়ে আগামী এগারো মাসের আমদানির খরচ মেটানো সম্ভব। কথাটি মিলিয়ে দেখার জন্য সামান্য ওয়েব সার্চই যথেষ্ট। দেখা যাবে, ২০২৪ অর্থবর্ষে ভারতের মোট আমদানির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৭২০ বিনিয়ন ডলারের কাছাকাছি— অর্থাৎ, এগারো মাসে আমদানির গড় ব্যয় ৬৬০ বিলিয়ন ডলার। আর, এই মুহূর্তে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে রয়েছে ৬৫৮ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং, অর্থ মন্ত্রকের রিপোর্ট মোটেই মিথ্যা বলছে না। অন্য দিকে, বিরোধীরা দাবি করছেন যে, ভারতে প্রকৃত মজুরির বৃদ্ধির হার (অর্থাৎ টাকার অঙ্কে মজুরি বৃদ্ধির হারের থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিলে যা থাকে) অত্যন্ত কম। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত অর্থনৈতিক সমীক্ষা এই কথার সাক্ষী দেবে— ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতের বেতনভোগী পুরুষ-শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমেছে ৬.৪ শতাংশ, মহিলাদের ক্ষেত্রে কমেছে ১২.৫ শতাংশ; স্বনিয়োজিত কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রকৃত আয় কমেছে আরও অনেক বেশি হারে। অর্থাৎ, বিরোধীদের দাবিও তথ্য-সমর্থিত— এবং, তাতে যে ছবিটি ফুটে উঠছে, তা ভয়াবহ; আর্থিক সুস্বাস্থ্যের দাবির সঙ্গে যার বিন্দুমাত্র সামঞ্জস্য নেই। প্রশ্ন হল, একই অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে একই সঙ্গে এমন বিপরীতমুখী ছবি সত্য হয় কী ভাবে?
অর্থব্যবস্থার দিকে কে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে তাকাচ্ছেন, তার উপরে নির্ভর করে যে, তিনি কী দেখবেন। কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টিকোণটি গত এক দশক ধরেই পরিচিত— তাঁরা ট্রিকল ডাউন তত্ত্বে বিশ্বাসী, অর্থাৎ অর্থব্যবস্থায় বৃদ্ধি ঘটতে থাকলে তা নিজের জোরেই চুইয়ে নামবে সর্বনিম্ন স্তরে। তার জন্য সরকারের বিশেষ কিছু করণীয় নেই, শুধু বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ বজায় রাখতে পারলেই যথেষ্ট। সে দিক থেকে দেখলে, কেন্দ্রীয় সরকার যা বলছে, তা ঠিক— মূল্যস্ফীতির হার আপাতত নিয়ন্ত্রণে, বিদেশি বিনিয়োগও আসছে, অতএব আজ না হোক পরশুর পরের দিন সেই বৃদ্ধির সুফল নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবে। উদ্বিগ্ন না হয়ে অমৃতকালের প্রতিশ্রুতিতে ভরসা করাই শ্রেয়। অন্য দিকে, যিনি মনে করেন যে, আর্থিক বৃদ্ধির ফল সরাসরি সবার কাছে পৌঁছয় না, তার জন্য সরকারের কিছু করণীয় আছে, তাঁর কাছে সরকারের এই আশ্বাস অর্থহীন ঠেকবে। তাঁরা মনে করিয়ে দেবেন, সাধারণ মানুষের কাছে আর্থিক বৃদ্ধির সুফল পৌঁছনোর কার্যত একমাত্র রাস্তা হল শ্রমের বাজার— মজুরি বা বেতনই তাঁদের আর্থিক উন্নতির ভাগ দিতে পারে। শ্রমের বাজার কতখানি বিধ্বস্ত, তার প্রমাণ সরকারি অর্থনৈতিক সমীক্ষাতেই রয়েছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান নিয়ে কেন্দ্রের প্রচারের শেষ নেই, তাও যে অন্তঃসারশূন্য, গবেষকরা সে কথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ঘটেছে মূলত অবৈতনিক পারিবারিক ক্ষেত্রে স্বনিযুক্তির মাধ্যমে— যাকে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব বলে, এটি তারই একটি রূপ। সরকারি নীতি আয়োগের সদস্য অরবিন্দ ভিরমানি দিনকয়েক আগেই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, যাঁরা নিয়মিত বেতনের চাকরি করেন, তাঁদের অবস্থাও দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। প্রশ্ন হল, কোন দৃষ্টিকোণটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য? ভারতীয় অর্থব্যবস্থার সাম্প্রতিক ইতিহাসকে যদি সাক্ষী মানতে হয়, তবে ট্রিকল ডাউন তত্ত্বের উপরে ভরসা করার উপায় নেই। এই কথাটি বারে বারে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।