R G Kar Hospital Incident

নুনের ছিটে

কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য ‘সেফ জ়োন’ তৈরি করা, কিংবা মেয়েদের দল বেঁধে কাজ করতে বলা, এগুলো একান্তই কাঁচা চিন্তার পরিচয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৫২
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

আরজি কর-কাণ্ডের পরে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তার দাবির মুখে সরকার তড়িঘড়ি দুটো তালিকা প্রকাশ করল— লালবাজারের পনেরো দফা, আর নবান্নের সতেরো দফা সুরক্ষা পরিকল্পনা। তাতে এটুকুই বোঝা গেল যে, এ রাজ্যে মেয়েদের নিরাপত্তার লড়াই আরও দীর্ঘ ও কঠিন হতে চলেছে। মেয়েদের রাতে সুরক্ষা দিতে তাঁদের নাইট শিফট থেকে ‘যত দূর সম্ভব অব্যাহতি দেওয়া’ উচিত, সরকারের এই প্রস্তাব যেন ক্ষতস্থানে নুনের ছিটে। এ কোন পচা-গলা মানসিকতার প্রকাশ? ‘রাত দখল’ কর্মসূচি করে মেয়েরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও শহর, গ্রামে, দিনে-রাতে যে কোনও সময়ে, কাজ করার, বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার অধিকার তাঁদের রয়েছে। সেই অধিকার সুরক্ষিত রাখা সরকারের কর্তব্য। রাতে মেয়েদের ‘অব্যাহতি দেওয়া’র প্রস্তাব দিয়ে বস্তুত সরকার নিজের সেই কর্তব্য থেকে অব্যাহতি পেতে চায়। কোন যুক্তিতে একবিংশ শতকের এক গণতন্ত্রে নির্বাচিত সরকার কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যকে আশকারা দেয়? ‘রাতে মেয়েদের না বেরোনোই ভাল’, এই মনোভাব থেকেই ধর্ষণের পরে প্রশ্ন তোলা হয়, মেয়েটি রাতে ওই জায়গায় কী করছিল? এ হল সেই উনিশ শতকীয় পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, যা মেয়েদের মর্যাদা দেওয়ার নামে ঘরে বন্দি করে। রাতে মেয়েদের কাজ থেকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়ার অর্থ, তাঁদের কর্মনিযুক্তির সুযোগ, রোজগারের পরিমাণ আরও কমানো। এ কি পদক্ষেপ, না পদাঘাত?

Advertisement

কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য ‘সেফ জ়োন’ তৈরি করা, কিংবা মেয়েদের দল বেঁধে কাজ করতে বলা, এগুলো একান্তই কাঁচা চিন্তার পরিচয়। কর্মক্ষেত্রের কয়েকটা এলাকা নিরাপদ, বাকিগুলো নিরাপদ নয়, এ কথার অর্থ কী? সব ধরনের পেশায় দল বেঁধে কাজ করার সুযোগই বা কোথায়? আরজি কর-কাণ্ডকে সামনে রেখেই বলা যায়, হাসপাতালের ভিতরের সেমিনার রুম কি ‘সেফ জ়োন’ ছিল না? না কি, মহিলা ডাক্তাররা দল বেঁধে ঘুমোতে যাবেন, এমন প্রত্যাশা করে সরকার? যে আশাকর্মী প্রসূতিকে নিয়ে মাঝরাতে হাসপাতালে যান, তিনি কার সঙ্গে দল বাঁধবেন? শিয়ালদহ থেকে রাত এগারোটার লোকাল ধরে যে মহিলা ব্যবসায়ী বাড়ি ফেরেন, তাঁর ‘সেফ জ়োন’ কোথায়? ‘মেয়েদের নিরাপত্তায় পদক্ষেপ’ শিরোনাম হলেও, সতেরো দফার সাতটিই মেডিক্যাল কলেজ ও সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো সংক্রান্ত। অথচ, রাজ্যের অধিকাংশ মহিলা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক বা ব্যবসায়ী, অগণিত মেয়ের কর্মস্থল হল রাস্তা। অনেকেই মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন, বা ভোরে উঠে কাজে যান। যাঁদের স্মার্ট ফোন নেই, তাঁরা অ্যাপ ডাউনলোড করবেন কী করে? সিসিটিভি, প্রহরীর টহল, গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র, এগুলি নিরাপত্তার বহিরঙ্গ মাত্র। সুরক্ষা পরিকাঠামো নড়বড়ে হলে দেখনদারিতে লাভ নেই।

সরকারি হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যা সব মেয়েকে আঘাত করেছিল। কর্মক্ষেত্রে, যাতায়াতের পথে, অবিচ্ছিন্ন নারীহিংসার সুবিচারের দাবি করেছিলেন সব পেশার, সব শ্রেণির মেয়েরা। বাজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, ইটভাটা থেকে হাসপাতাল, রাস্তার হকার থেকে হাই কোর্টের আইনজীবী, সর্বত্র মেয়েরা নিয়ত লাঞ্ছিত হচ্ছেন। তাঁরা সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে চান। কী করে তার ব্যবস্থা করা সম্ভব, তা স্থির করতে হলে চিকিৎসক সংগঠন,
মহিলা সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের নানা অংশের পরামর্শ কি সরকারের প্রয়োজন ছিল না? ১০০, ১১২ হেল্পলাইন, বা প্রচলিত অ্যাপগুলি মেয়েদের জন্য কতখানি কার্যকর হয়েছে, নির্ভয়া তহবিলের টাকা এ রাজ্যের মেয়েদের কী কাজে লেগেছে, এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজারও দরকার ছিল। লালবাজার এবং নবান্নের তালিকার প্রস্তাবগুলিতে আমলাসুলভ শৃঙ্খলা, পুলিশ-সুলভ দৃঢ়তা কিংবা প্রাজ্ঞ নেতার কাণ্ডজ্ঞান, কিছুই পাওয়া গেল না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement